লিভার
অধ্যাপক মবিন খান
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল সৃষ্টিসমূহের মধ্যে মানব শরীর হলো সবচেয়ে আধুনিক এবং বিস্ময়কর সৃষ্টি। শরীরকে সচল রাখার জন্য মানবদেহের যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো বিশেষভাবে গুরম্নত্বপূর্ণ সেগুলো হলোঃ মস্তিôষ্ক, হৃদপিন্ড, ফুসফুস, লিভার, কিডনী ও পরিপাকতন্ত্র। পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে রয়েছেঃ ক) পাকস্থলী এবং খ) অন্ত্র।
মানবদেহের এই যন্ত্রাংশগুলো সবাই নিজেদের সুনির্দিষ্ট কাজে ব্যস্তô থাকে এবং একে অপরের কাজের সমন্বয় সাধন করে।
যেমনঃ মস্তিôষ্ক, শরীরের সকল প্রকার স্নায়বিক ক্রিয়াসমূহ পরিচালনা করে। ফুসফুস বাতাস থেকে অিজেন গ্রহণ করে এবং দূষিত বায়ু বের করে দেয়। হৃদপিন্ড, রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে অিজেন সরবরাহ করে। পরিপাকতন্ত্র খাদ্য পরিপাক ও শোষণের পর তা লিভারে পাঠিয়ে দেয়। আর কিডনী, শরীরের বর্জø পদার্থ দূরীভূত করে।
এখন আসা যাক, লিভার কোথায় আছে এবং কি কাজ করেঃ
লিভার মানব শরীরের সবচেয়ে বড় সলিড অর্গান । একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে লিভারের ওজন ১ থেকে ১·৫০ কেজি। লিভারকে আলস্নাহপাক শক্তির উৎস বা মেষণর র্ওর্টধমভ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। যেমন ধরম্নন, বিদ্যুতের বাতি জ্বলতে হলে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। তেমনি আমাদের সবকটি যন্ত্রপাতি চলাচলের জন্য শক্তির উৎস হলো লিভার।
আমাদের মস্তিôষ্ক, হৃদপিন্ড, ফুসফুস, কিডনী ইত্যাদি সবকটি যন্ত্রের সুষ্ঠু কাজের ড়্গমতা নির্ভর করে লিভার থেকে নির্গত শক্তির উপর।
আমরা যা খাই, যেমন-শর্করা, আমিষ, চর্বিজাতীয় পদার্থ, খনিজ দ্রব্য ইত্যাদি সবগুলো ভেঙ্গে একমাত্র লিভারই প্রক্রিয়াজাত করে।
প্রক্রিয়াজাতঃ খাদ্য উপাদানগুলোকে শরীরের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে, নিয়ন্ত্রিত পরিমাণে লিভার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সরবরাহ করে। সেজন্য আলস্নাহপাক লিভারকে একটি বিরাট মহাবিস্ময়কর রাসায়নিক কারখানা বা উদণবধডটফ এটর্ডমরহ হিসাবে সৃষ্টি করে পেটের মধ্যে স্থাপন করেছেন।
মানুষের রক্তের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার জন্য উমটথলফর্টধমভ এটর্ডমর্র নামে প্রবাহিত অসংখ্য রসায়ন বা উদণবধডটফ্র রয়েছে যা রক্তকে সঞ্চালিত রাখে। সবকটি উমটথলফর্টধমভ এটর্ডমর্র শুধুমাত্র লিভার থেকে তৈরি হয়। রক্তের সঞ্চালন এবং জমাট বাঁধার ড়্গমতা একমাত্র লিভারের কার্যড়্গমতার উপর নির্ভরশীল।
অধিকন্তু, আমরা যা কিছু খাই, সেই খাবারগুলো পরিপাকতন্ত্রে প্রাথমিক ঊধথর্ণ্রধমভ বা হজমের জন্য পিত্তরস অপরিহার্য। পিত্তরস ছাড়া খাদ্যবস্তু হজম সম্ভব নয়। এই পিত্তরস শুধুমাত্র লিভার কোষ তৈরি করে।
আপৎকালীন ব্যবহারের জন্য ভিটামিন এ ডি ই কে লিভারে জমা থাকে। তাছাড়া প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান বা করটডণ ঋফণবণর্ভ যেমনঃ আয়রন, কপার, ম্যাঙ্গানিজ ইত্যাদি লিভারে জমা থাকে। মোট কথা লিভার এতসব কাজ করে থাকে, যা বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যায় না এবং এমনসব কাজ করে যা আমরা জানি না।
এখন আমাদের দেশে লিভারের কি কি অসুখ-বিসুখ হয়, সে সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত করতে চাই।
আমাদের দেশে লিভারের যে রোগগুলো হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলোঃ ১) ভাইরাল হেপাটাইটিস যা জন্ডিস নামে পরিচিত। ২) লিভার সিরোসিস ৩) লিভার ক্যান্সার ৪) লিভারের ফোঁড়া ৫) পিত্তথলির বা পিত্তনালীর রোগ ৬) লিভারের জন্মগত ও মেটাবলিক রোগ ইত্যাদি।
তবে এখানে উলেস্নখযোগ্য যে, লিভারের অসুখের লড়্গণাদি সহসাই প্রকাশ পায় না, কারণ লিভারের এগারো ভাগের এক ভাগ অংশ যদি কারো ভালো থাকে, তবে লিভারের অসুখ প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। আলস্নাহতায়ালা এত বিশাল পরিমাণ ধারণ ও সহনীয় ড়্গমতা দিয়ে লিভার তৈরি করেছেন যে, খুব ড়্গতিগ্রস্তô না হলে লিভারের রোগ বোঝা যায় না।
লিভারের অসুখ বিসুখের মধ্যে প্রধানতম রোগ হলো ভাইবাল হেপাটাইটিস বা সাধারণের মাঝে জন্ডিস নামে অধিক পরিচিত। আমাদের দেশে ঘরে ঘরে যে জন্ডিস দেখা যায় বা মহামারী আকারে যে জন্ডিস হয় তা একটি ভাইরাস পরিবার দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে।
এই ভাইরাস পরিবারকে নামকরণ করা হয়েছে হেপাটাইটিস এ বি সি ডি এবং ই। এই ভাইরাসগুলোকে মূলতঃ দুভাগে ভাগ করা যায় যেমনকৈ) পানি ও খাদ্যবাহিত ভাইরাস, যথাক্রমে হেপাটাইটিস এ ও হেপাটাইটিস ই এবং খ) রক্ত কিংবা দূষিত সিরিঞ্জ সুই-এর মাধ্যমে বাহিত ভাইরাস, যথাÌৈহপাটাইটিস বি, সি ও ডি।
দূষিত পানি কিংবা খাদ্যবস্তু গ্রহণের ২-৬ সপ্তাহের মধ্যে হেপাটাইটিস এ এবং ই দ্বারা আক্রান্তô হলে লড়্গণ দেখা যায়। অপরদিকে হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগের লড়্গণ দূষিত রক্ত কিংবা সিরিঞ্জের মাধ্যমে রোগ সংক্রমিত হওয়ার ৪-৬ মাসের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। রোগের লড়্গণ দিয়ে বোঝার উপায় নেই যে, কোন ভাইরাস দ্বারা জন্ডিস হয়েছে। জন্ডিসের অন্যতম লড়্গণ হলোহৈঠাৎ করে বমিভাব, কিংবা তীব্র বমি হওয়া। খাদ্য গ্রহণে অরম্নচি, অনীহা কিংবা তীব্র দুর্বলতা, কখনও কখনও জ্বর জ্বর ভাব বা জ্বরের মাধ্যমেও রোগের সূত্রপাত হতে পারে।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন হলো, আপনি করবেন কি? আমাদের দেশে জন্ডিসের চিকিৎসা মহা বিভ্রাটে ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ জন্ডিস হয়েছে শুনলে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই এক একটা পরামর্শ প্রদান করেন। সাধারণতঃ বেশীরভাগ ড়্গেত্রেই রোগী ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
ভাইরাল হেপাটাইটিসের প্রথম চিকিৎসা হলোকৈ) শরীরের পরিপূর্ণ বিশ্রাম এবং খ) স্বাভাবিক-খাওয়া দাওয়া চালিয়ে যাওয়া। এখানেই সমস্যা! কারণ সবাই মনে করেন, জন্ডিস হয়েছে তাই এখন বেশী বেশী ফলের রস ও পানি খেতে হবে এবং হলুদ মরিচ খাওয়া যাবে না।
এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমি বলবো-জন্ডিস হলে রোগীকে হলুদ, মরিচ, তরি-তরকারী, মাছ-মাংস ইত্যাদি স্বাভাবিক খাবার খেতে দিন। ফল, ডাবের পানি, আখের রস ইত্যাদি খাওয়াবেন না। ঘন ঘন গোসল করাবেন না। জনমনে আরো কুসংস্কার রয়েছে, যেমন-নাকে নস্যি দেয়া কিংবা লতাপাতা খাওয়ানো। এ সমস্তô চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। নাকে নস্যি দেয়ার ফলে অনেকে মারাত্মক সংকটাপন্ন অবস্থায় আমাদের কাছে আসেন। জন্ডিস হওয়ার ১-২ সপ্তাহের মধ্যে যদি রোগের লড়্গণ ভালো না হয়, তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন। জন্ডিস হওয়ার পর কেউ অস্থিরতা, অস্বাভাবিক আচরণ করলে বা অজ্ঞান হলে, এটা মারাত্মক জরম্নরী অবস্থা। তাকে অনতিবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
অন্যদিকে, লিভারের দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহের ফলে যে সমস্তô রোগ হয়ে থাকে তাকে ক্রনিক হেপাটাইটিস বলে। বাংলাদেশে ক্রনিক হেপাটাইটিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। রোগী প্রাথমিক অবস্থায় বুঝতেই পারেন না। কখন তিনি বি অথবা সি ভাইরাসে আক্রান্তô হয়েছেন। অনেক ড়্গেত্রে কখনো কোন কারণে রক্ত পরীড়্গা করলে হঠাৎ হেপাটাইটিস বি অথবা হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ধরা পড়ে।
হেপাটাইটিস বি এবং সি সংক্রমণ মাসের পর মাস ধরে চলতে থাকলে আপনার লিভার ড়্গতিগ্রস্তô হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। প্রথম পর্যায়ে সচেতন না হলে, বোঝার কোন উপায় নেই। লিভার ড়্গতিগ্রস্তô হলে আস্তেô আস্তেô রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন-দুর্বলতা, খাওয়ার প্রতি অনীহা, শরীরের ওজন কমে যাওয়া কিংবা জন্ডিস প্রকাশিত হওয়া। এরপরও যদি রোগী বুঝতে না পারেন, তাহলে ক্রমান্বয়ে পেটে ও শরীরের অন্যান্য অংশে পানি আসবে। এমতাবস্থায়, লিভারের অবস্থা মারাত্মক হয়ে যায় এবং লিভার সিরোসিসে রূপ নেয়। সময় থাকতে চিকিৎসা শুরম্ন করলে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিস প্রতিরোধ করা যায়।
এবার আসা যাক লিভার ক্যান্সারের কথায়। আমাদের দেশ লিভার ক্যান্সারের মূল কারণ হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি ভাইরাস। এ দুটো ভাইরাসের সংক্রমণকে প্রতিহত করলে লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। লিভার ক্যান্সার হওয়ার পূর্বে সিরোসিস হয় এই সিরোসিস প্রতিহত করতে পারলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রাথমিক অবস্থায় খুব ছোট আকারের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়লে তা প্রতিরোধ করা যায়। আর তা না হলে, পরবর্তীতে এটা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
এখন আসা যাক, লিভারের অসুখের জন্য আপনি কতটা দায়ী। বেশীরভাগ ড়্গেত্রেই হেপাটাইটিস ই এবং হেপাটাইটিস এ আপনার খাদ্যভ্যাসের জন্য হয়ে থাকে। যত্রতত্র বিক্রি হওয়া রাস্তôার ধারের খোলা খাবার, কিংবা আখের রস অথবা সরবৎ যারা খান তাদেরই এই জন্ডিস হয়। যারা শহর অঞ্চলে বসবাস করেন কিন্তু পানি না ফুটিয়ে পান করেন কিংবা গ্রামেগঞ্জে টিউবওয়েলবিহীন স্থানে যারা ডোবা বা পুকুরের পানি পান করেন তারা হেপাটাইটিস এ বা ই ভাইরাসে আক্রান্তô হতে পারেন।
অন্যদিকে, দুষিত সুঁই কিংবা দূষিত রক্ত গ্রহণের ফলে অথবা ব্যক্তিগত ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের ফলে হেপাটাইটিস বি এবং সিজনিত লিভার রোগ হতে পারে, তাছাড়া যত্রতত্র খোলা খাবার গ্রহণের ফলে লিভারে ফোঁড়া (ীধশণর ইঠ্রডণ্র্র) হতে পারে। মদ্যপান বা এলকোহল খেয়ে যারা অভ্যস্তô বা আসক্ত তাদের লিভারের রোগ অবশ্যম্ভাবী। যে কোন ধরনের নেশা করলে লিভার আক্রান্তô হবেই।
এখানে উলেস্নখ করতে চাই, জনগণের অনেক সংশয় রয়েছে লিভারের কঠিন রোগের চিকিৎসা কি বাংলাদেশে হবে?
আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই এবং সবাইকে জানাতে চাই, বাংলাদেশে বর্তমানে হেপাটাইটিস বি এবং সি রোগ নির্ণয়, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসক সবাই আছেন। অযথা হয়রানি হবেন না।
লিভার রোগ থেকে আপনি কিভাবে বাঁচতে পারেন এবার সে সম্পর্কে আলোকপাত করিঃ
আমাদের দেশে যে সমস্তô লিভার রোগ হয় তারা বেশীরভাগই প্রতিরোধযোগ্য যেমন ধরম্নন হেপাটাইটিস এ এবং ই যেখানে সেখানে খোলা খাবার গ্রহণের অভ্যাস ত্যাগ করলেই এই দুটো রোগ হবে না।
হেপাটাইটিস এ রোগের টিকা এখন আমাদের দেশে পাওয়া যায়। তাই শিশুদের হেপাটাইটিস এ টিকা দিতে ভুলবেন না। মরণ ঘাতী রোগ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের টিকা সর্বত্র পাওয়া যায়। তাই সকল বয়সের মানুষের এই টিকা অবশ্যই নেয়া উচিত। পরিবারের কোন সদস্যের হেপাটাইটিস বি হলে অন্যান্য সকলকে এর প্রতিষেধক টিকা নেয়া জরম্নরী।
হেপাটাইটিস সি এর প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার হয়নি। তাই সাবধানতাই বর্তমানে এই রোগ থেকে বাঁচার উপায়।
রক্ত গ্রহণের পূর্বে পরীড়্গা করে নিতে হবে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি মুক্ত কিনা। ইনজেকশন নেয়ার সময় দূষিত সুঁই ব্যবহার করবেন না। সকল ঝুঁকিপূর্ণ ও অনৈতিক শারিরীক সম্পর্ক বা আচরণ পরিহার করম্নন। লিভার সুস্থ রাখতে আপনার সচেতনতাই হতে পারে অন্যতম পন্থা।
লেখকঃ বিশিষ্ট লিভার বিশেষজ্ঞ এবং
চেয়ারম্যান হেপাটোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
হেপাটাইটিস-বি এইডসের মতোই এক ঘাতক ব্যাধি
ডা. মুজিবুর রহমান
ঘাতক ব্যাধি এইচআইভি/এইডসের কথা আজ আর কারো অজানা নয়। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের কারণে এ বিষয়ে অনেক সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। গত নভেম্বর মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রাপ্ত সমীক্ষায় বর্তমানে পৃথিবীতে ৩৩.২ মিলিয়ন নারী-পুরুষ এইচআইভি/এইডস আক্রান্ত বলে জানা যায়। এইচআইভি আক্রান্ত মহিলাদের সংখ্যা হচ্ছে ১৫.৪ মিলিয়ন আর নিষ্পাপ শিশুর সংখ্যা প্রায় ২.৫ মিলিয়ন। ২০০৭ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২.৫ মিলিয়ন নারী-পুরুষ নতুন করে এইচআইভি আক্রান্ত হয় আর এ বছর এইডসের কারণে মৃতের সংখ্যা ২.৪ মিলিয়ন। ১৯৮১ সালে প্রথম মানবদেহে এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এ পর্যন্ত মোট ২৫ মিলিয়ন নারী-পুরুষ এ রোগের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। পৃথিবীতে যত এইচআইভি/এইডসের রোগী রয়েছে তার প্রায় ৬১ শতাংশই সাব সাহারান আফ্রিকার অধিবাসী। ব্যাপক প্রচারের কারণে এইচআইভি’র ভয়াবহ চিত্র আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হলেও প্রয়োজনীয় প্রচারের অভাবে এইচআইভি’র মতোই আর এক প্রলয়ঙ্করী ব্যাধি হেপাটাইটিস-বি রয়ে গেছে আমাদের দৃষ্টির অগোচরে। নীরব ঘাতক এ সংক্রামক ব্যাধিটি প্রতি মিনিটে কেড়ে নেয় দু’জন নারী-পুরুষের প্রাণ। পৃথিবীতে প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন অর্থাৎ দু’বিলিয়ন নারী-পুরুষই হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত। পৃথিবীর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন নারী-পুরুষ দীর্ঘমেয়াদের জন্য তাদের দেহে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের জীবাণু বহন করে চলেছে। প্রতি বছর ১০-৩০ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হচ্ছে। হেপাটাইটিস-বি ও এ রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে প্রতি বছর এক মিলিয়ন মানুষ প্রাণ হারায়। হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা এইচআইভি ভাইরাসের চেয়ে শতগুণ বেশি। আর এ দুটো রোগ প্রায় একই উপায়ে সংক্রমিত হয়। বয়স্কদের তুলনায় শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক রোগীদের ওপর এ রোগের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব অধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। এইচআইভি’র চেয়ে এ রোগ অধিক ভয়ঙ্কর হলেও আশার বিষয় হচ্ছে এইচআইভি প্রতিরোধে অদ্যাবধি কোনো প্রতিশোধক টিকা আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু হেপাটাইটিস-বি প্রতিরোধে বাজারে রয়েছে পর্যাপ্ত ও কার্যকরী টিকার ব্যবস্থা।
হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কাদের বেশি?
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অধিবাসী যেমন সাব সাহারান আফ্রিকা, এশিয়ার অধিকাংশ দেশ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অধিবাসী ও আলাস্কার আদি অধিবাসীদের মধ্যে হেপাটাইটিস-বি রোগের প্রকোপ অন্যদের তুলনায় অধিক। ষ রক্তক্ষরণ ও অন্যান্য কারণে সৃষ্ট রক্তশূন্যতার চিকিৎসায় বারবার ব্লাড ট্রান্সফিউশন গ্রহণ করা হলে। ষ কিডনি বিকল হওয়ার কারণে হিমোডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হলে। ষ সমকামী পুরুষদের মধ্যে যৌন মিলনের ফলে। ষ হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে সংক্রমিত নারী-পুরুষের মধ্যে এবং একাধিক নারী-পুরুষের সাথে যৌন মিলন। ষ ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য সেবন। ষ একই নিডেল ও সিরিঞ্জের মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তির মাদকদ্রব্য গ্রহণ। ষ রোগীর দেহ থেকে রক্ত সংগ্রহ, স্যালাইন বা ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ করার সময় কিংবা ল্যাবরেটরিতে রক্ত ও রোগীর দেহ থেকে সংগৃহীত তরল পদার্থ নিয়ে পরীক্ষা করার সময় অসাবধানতাবশত হেপাটাইটিস-বি সংক্রমিত রক্ত কিংবা অন্য তরল জাতীয় পদার্থ স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্তের সংস্পর্শে এলে।
ষ হেপাটাইটিস-বি রোগের প্রাদুর্ভাব অধিক এ ধরনের এলাকায় ছয় মাসের অধিক সময় অবস্থান করা। ষ নার্সিং হোম বা কোনো আবাসিক প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ সময়ের জন্য অবস্থান বা কর্মরত থাকা। ষ হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত মায়ের গর্ভজাত সন্তানদের অনাক্রান্ত মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া। সন্তানদের তুলনায় হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক।
হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হলে বোঝার উপায় কী?
উপরোল্লিখিত যেকোনো উপায়ে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের জীবাণু দেহে অনুপ্রবেশ করার পর রোগের লক্ষণ দেখা দিতে এক থেকে ছ’মাস সময় লাগতে পারে। আর এ সময়কে বলা হয় ইনকিউবেশন পিরিয়ড। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের ওপর ভিত্তি করে রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ ভিন্ন ধরনের হতে পারে। শিশু ও যুব বয়সের ছেলে-মেয়েরা হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত হলে তাদের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ তেমন একটা দেখা যায় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামান্য লক্ষণাদি থেকে শুরু লিভার অকেজো হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত গড়াতে পারে। যেসব লক্ষণাদি দেখে হেপাটাইটিস বি’র সংক্রমণ বোঝা যায় তার মধ্যে রয়েছে গা মেজ মেজ করা, অবসাদ অনুভব করা, মাথা ব্যথা, গা চুলকানো, পেটে ব্যথা, বিশেষ করে ডান দিকের উপরিভাগে, ক্ষুধামন্দা, বমি ভাব থেকে শুরু বমি হওয়া, জ্বর অনুভূত হওয়া চোখ ও প্রস্রাবের রঙ হলুদ হওয়া। অস্থিস#িঅতে ব্যথা অনুভব করা ইত্যাদি। লিভারের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহের কারণে শারীরিক দুর্বলতা ও অবসাদগ্রস্ততা ছাড়া আর কোনো লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। তবে দীর্ঘদিনের প্রদাহজনিত কারণে কারো কারো বেলায় লিভার অকার্যকর হয়ে কিংবা সিরোসিসের মতো জটিল উপসর্গের কারণে নানাবিধ লক্ষণ দেখা দিতে পারে। আর এ অবস্থাকে এন্ড স্টেজ লিভার ডিজিজ বলা হয়।
হেপাটাইটিস-বি নিরূপণের উপায় কী?
রোগের লক্ষণ প্রাথমিকভাবে বলে দেবে আপনি সম্ভবত হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে রক্ত পরীক্ষাই হচ্ছে নির্ভরযোগ্য ও নিশ্চিত উপায়। রক্তে হেপাটাইটিস-বি সারফেস অস্টিজেন, হেপাটাইটিস-বি আইজিএম কোর এন্টিজেন, হেপাটাইটিস-বি ই এন্টিজেন ও সেই সাথে লিভার এনজাইমের অধিক মাত্রা নিশ্চিতভাবে হেপাটাইটিস-বি একিউট সংক্রমণের কথা বলে দেবে। ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিস-বি নিশ্চিত হওয়ার জন্য রক্তে হেপাটাইটিস-বি সারফেস এন্টিজেনের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি, হেপাটাইটিস-বি কোর আইজিজি এন্টিজেন, হেপাটাইটিস ই এন্টিজেন ও লিভার এনজাইম পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি।
লেখকঃ বাধ্যর্কজনিত ব্যাধি বিশেষজ্ঞ, জামাইকা, নিউইয়র্ক
হেপাটাইটিস বি পজিটিভ হলে
ডা. বিমল কুমার আগরওয়ালা
“হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস লিভারের কতক জটিল সমস্যার জন্য দায়ী হলেও সব সময় তা নয়”-এ সত্যটি জানার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বর্তমান সমাজে অপচিকিৎসার যেন শেষ নেই। রক্ত পরীক্ষায় এইচবিএসএজি অর্থাৎ হেপাটাইটিস ‘বি’পজিটিভ হলেই অনেকে এটাকে কঠিন অসুখ ভেবে বসেন। ফলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে প্রচুর অর্থ অপচয় করেন।
হয়তো মনে প্রশ্ন জাগবে, তাহলে এ ক্ষেত্রে কি কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই? হ্যাঁ, এক কথায় বলা যায় যে, যদি লিভারের কর্মক্ষমতা স্বাভাবিক থাকে এবং দৈহিক কোনো উপসর্গ পরিলক্ষিত না হয় তাহলে শুধু হেপাটাইটিস ‘বি’ পজিটিভে কোনো চিকিৎসা ফলদায়ক নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখনো এমন কোনো ওষুধ আবিস্কৃত হয়নি যা সহজেই এটাকে নেগেটিভে পরিণত করতে পারে। ‘ইন্টারফেরন’ নামক একধরনের ইনজেকশন রয়েছে যা প্রয়োগ করতে হয়, তার পরও এই ওষুধের কার্যকারিতা মাত্র ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে সফল হয়। মনে রাখা দরকার, দেহে এই ভাইরাস উপস্থিত থাকলে তার তিন ধরনের গতিবিধি দেখা যায়ঃ
এক. শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সবল থাকলে অনেকের ক্ষেত্রে এটি নিজে নিজেই নেগেটিভ হয়ে যায়। দুই. অনেকের সুপ্তাবস্থায় এই ভাইরাস সারাজীবন থাকতে পারে যা দেহের কোনো ক্ষতি সাধন করে না। তিন. কারো বা লিভার সিরোসিস কিংবা ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ দেখা দেয় বিশেষ করে রক্তে এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রস্তাবিত নিয়মাবলি অনুসরণ করা না হলে।
হেপাটাইটিস ‘বি’ পজিটিভে চিকিৎসা
ষ নিয়মিত শরীরচর্চা। পর্যাপ্ত পরিমাণ শাকসবজি ও ফল আহার। প্রত্যহ ১০-১৫ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান। মাদকাশক্তি, উন্মুক্ত খাবার সেবন এবং লিভারের ওপর ক্ষতিকারক যেকোনো ওষুধ খাওয়া থেকে সাবধানতা। শারীরিক উপসর্গ অনুযায়ী যেমন বমি, দুর্বলতা, জ্বর, পেটব্যথা হলে তার চিকিৎসা।
প্রতিরোধে করণীয়
ষ নিয়মমতো ভেকসিন নেয়া। উল্লেখ্য, হেপাটাইটিস ‘বি’ পজিটিভ হলে ভেকসিন নিয়ে লাভ নেই। ? যেসব উপায়ে সংক্রমিত ব্যক্তি থেকে এই ভাইরাস সুস্থ দেহে ছড়ায় সে বিষয়ে সচেতন হওয়া। সাধারণত রক্ত, মুখের লালা, মূত্র, বীর্য ও মাসিকের পথে নিঃসৃত রস হেপাটাইটিস ‘বি’ জীবাণুর বাহন। উল্লেখ্য, সেলুনে সংক্রমিত খুর কিংবা ব্লেডের মাধ্যমে এই জীবাণু ছড়ানোর সম্ভাবনা অধিক থাকে। ষ ভুলবশত সংক্রমিত রক্তের সংস্পর্শে এলে যেমন সুচ বিঁধে রক্ত বেরোলে হাইপারইমিউন সেরাম গ্লোবিন ইনজেকশন মাংসপেশিতে প্রয়োগ করা।
ফ্যাটি লিভার
অধ্যাপক ডা. সেলিমুর রহমান
ফ্যাটি লিভার মানে লিভারে চর্বি জমা। শব্দটি বর্তমানে বেশ প্রচলিত। ঐতিহাসিকভাবে এটি অ্যালকোহল বা অতিরিক্ত মদ্যপানের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু যারা অ্যালকোহল বা মদ্যপানের সাথে যুক্ত নন, ইদানীং তাদের মাঝেও এই রোগের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ।
ফ্যাটি লিভারের কারণ
ফ্যাটি লিভার সাধারণত মধ্যবয়সী মহিলাদের দেখা দেয়। কিন্তু পুরুষদের মাঝেও এর সংখ্যা কম নয়। সাধারণভাবে এর কারণ অজ্ঞাত। তবে, যাদের স্বাস্থ্য মোটা বা মেদবহুল ও ডায়বেটিসে আক্রান্ত অথবা রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি তাদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা দেয়। এসব রোগীর শরীরে ইনসুলিন রেজিসটেন্স থাকে। অর্থাৎ তাদের শরীরে ইনসুলিন থাকা সত্ত্বেও এর কার্যকারিতা কম হয়। যাদের ওজন আদর্শ ওজনের ১০-৪০ শতাংশ বেশি তাদের ফ্যাটি লিভার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ডায়বেটিস রোগীদের মধ্যে এর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি (৩৪-৭৫ শতাংশ)। যাদের রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি তাদের মধ্যে ২০-৪০ শতাংশ রোগী ফ্যাটি লিভারের ভোগেন। এ ছাড়া ফ্যাটি লিভারের অনেক কারণ রয়েছে।
ফ্যাটি লিভারের কারণ
ফ্যাটি লিভারের কারণ সম্পর্কে দুটো মতবাদ প্রচলিত। প্রথমটি হচ্ছে ইনসুলিন রেজিসটেন্স এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে আঘাত।
লক্ষণ
ফ্যাটি লিভার রোগীরা সাধারণত ক্লান্তি, অবসাদ, উপরের পেটের ডান দিক ব্যথা নিয়ে ডাক্তারদের কাছে আসেন। পরীক্ষা করলে দেখা যায়, রোগীদের এসজিপিটি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এদের বিলুরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, লিভারে এনজাইমের মাত্রা স্বাভাবিক অথচ লিভারের আল্ট্রাসনোগ্রামে চর্বির মাত্রা বেশি। রোগের বিস্তার দেখার জন্য লিভার বায়োপসি করতে হবে।
চিকিৎসা
ফ্যাটি লিভারের ১০০ শতাংশ কার্যকরি ওষুধ এখনো আবিষ্কার হয়নি। চিকিৎসার প্রথম শর্ত হচ্ছে, ঝুঁকিগুলো কমনো। অর্থাৎ মোটা লোকের স্বাস্থ্য কমাতে হবে, ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
শিশুর লিভারের রোগ বালাই
ডাজ্ঝ ইমনুল ইসলাম
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
লিভার বা যকৃৎ আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শরীরের প্রয়োজনীয় প্রোটিন, হরমোন তৈরি করা, কিডনি ও পিত্তের সাহায্যে শরীরকে বিষমুক্ত করা, বিপাক প্রক্রিয়ায় সাহায্য করা এবং দেহের রোগপ্রতিরোধ-ব্যবস্থা শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে শরীরে লিভার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। শিশুর লিভারের রোগ-বালাই নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
জন্ডিসঃ জন্ডিস কোনো রোগ নয়, লিভার রোগের উপসর্গমাত্র। রক্তে বিলোরুবিন নামক উপাদান স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেড়ে গেলে চোখ ও প্রস্রাব শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় হলুদ হতে দেখা যায়। রক্তে বিলোরুবিনের মাত্রা ৫ হলে ভালো আবার ২৫ হলে খারাপ। অবশ্য শুধু বিলোরুবিনের মাত্রা থেকে লিভারের অসুখের মাত্রা বোঝা সম্ভব নয়। এর জন্য আরও কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন। বলে রাখা দরকার, শুধু লিভারের অসুখেই জন্ডিস দেখা যায় না, আরও অনেক কারণেও জন্ডিস হতে পারে।
হেপাটাইটিসঃ হেপাটাইটিস হলো লিভারের প্রদাহ। এই প্রদাহ দুই ধরনের-ক্ষণস্থায়ী ও দীর্ঘস্থায়ী। ভাইরাস এ, বি, সি, ডি এবং ই দিয়ে মূলত হেপাটাইটিস ছড়ায়। এর মধ্যে এ এবং ই ভাইরাস ক্ষণস্থায়ী হেপাটাইটিসের জন্য দায়ী। এ এবং ই ভাইরাস দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। অন্যদিকে বি এবং সি ভাইরাস সংক্রমিত হয় রক্ত ও দেহরসের মাধ্যমে। বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থার মাধ্যমে লিভারের কার্যক্রম প্রথমে স্বাভাবিক হয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে শতকরা ৫০ জনের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ বা হেপাটাইটিস রোগ সৃষ্টি করে। সি ভাইরাসের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের হার ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
হেপাটাইটিসের লক্ষণঃ হেপাটাইটিসে আক্রান্ত শিশুদের লক্ষণগুলো ঘুরেফিরে প্রায় একই রকম। পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা, দুর্বলতা, স্বল্প জ্বর, হাত-পা চুলকানো ইত্যাদি। এ ছাড়া পরবর্তী সময়ে পানি জমে পেট ফুলে যাওয়া, রক্তবমি, আলকাতরার মতো কালো পায়খানা, এমনকি শিশু অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ আক্রান্ত শিশুর রক্ত পরীক্ষা করলে হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত কি না তা বোঝা যায়। রক্তে বিলোরুবিনের মাত্রা দেখার পাশাপাশি লিভার এনজাইমের মাত্রা দেখার প্রয়োজন হয়।
শিশুটি কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হলো তা দেখার জন্য রক্তের আলাদা পরীক্ষা করতে হয়। রোগের তীব্রতা বোঝার জন্য রক্তের প্রোথমবিন টাইম ও অ্যালবুমিন পরীক্ষা করা হয়।
রক্তের অ্যামোনিয়া মেপে শিশুর অজ্ঞান হওয়া সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। খাদ্যনালির এন্ডোসকপি ও পেটের আলট্রাসনোগ্রাম করে লিভার রোগের তীব্রতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কখনো কখনো লিভারের অবস্থা জানার জন্য বায়োপসি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসাঃ শিশুর পুষ্টির দিক খেয়াল করে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। পর্যাপ্ত প্রোটিনের সঙ্গে ফলমূল দেওয়া যাবে। অল্প লবণ দিয়ে রান্না করা খাবারের সঙ্গে পরিমিত পানি শিশুর পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পারে। এ সময় অল্প সেদ্ধ করা, হলুদ ছাড়া খাবার, ডাবের পানি, আখের রস, শিং মাছের ঝোল প্রভৃতির বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। কুসংস্কার বাদ দেওয়াই ভালো।
শিশুর দেহে পুষ্টির মাত্রা বজায় রেখে খাবার খাওয়ালে, সঙ্গে ইনফেকশন ও রক্তপাত ঠেকাতে পারলে লিভারের কোষগুলো সংগঠিত হয়ে কাজ শুরু করে।
পায়খানা বন্ধ থাকলে নিয়মিত পায়খানা হওয়ার জন্য ল্যাকটুলোজ সিরাপ ব্যবহার করা যেতে পারে। লিভার যদি রক্ত জমাট বাঁধার প্রভাবক ভিটামিন-কে তৈরি করতে না পারে, তাহলে ভিটামিন-কে ইনজেকশন দেওয়া হয়ে থাকে। পেটে পানি এলে, শরীর ফুলে গেলে শরীর থেকে পানি বের করার ট্যাবলেট খাওয়ানো হয় এবং এই পানির জন্য ইনফেকশন হতে পারে বলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের প্রয়োজন হয়। দীর্ঘমেয়াদি হেপাটাইটিসের জন্য ইন্টারফেরন ইনজেকশন এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে ওষুধ প্রয়োগ করে চিকিৎসা করা যেতে পারে। এটি বাংলাদেশে সম্ভব, তবে ব্যয়বহুল।
শিশুকে কখন হাসপাতালে ভর্তি করাবেনঃ শিশুর বারবার বমি হলে, রক্তে বিলোরুবিনের মাত্রা খুব বেড়ে গেলে, রক্তে চিনি ও পটাশিয়ামের মাত্রা কমে গেলে, শিশু অজ্ঞান হয়ে পড়লে অবশ্যই দেরি না করে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। ক্ষণস্থায়ী লিভার রোগে আক্রান্ত হলে শতকরা ৯৯টি শিশু সুস্থ জীবন ফিরে পাবে। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম। অন্যদিকে দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগে আক্রান্তদের সময়মতো রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা করলে লিভার সিরোসিসের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
প্রতিরোধঃ লিভারের অসুখ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। শিশুকে সুষম খাবার খাওয়াতে হবে। পরিমিত বিশ্রাম দিতে হবে। এ রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রধান উপায় হলো শরীরে রোগপ্রতিরোধ-ব্যবস্থা গড়ে তোলা, অর্থাৎ টিকা নেওয়া। তাই হেপাটাইটিস-বি এবং হেপাটাইটিস-এর ভ্যাকসিন নিতে হবে প্রত্যেককে। অযথা ভয় না পেয়ে সময়মতো চিকিৎসা নিন, ভালো থাকুন।
হেপাটাইটিস বি টিকা লিভার রোগের ঝুঁকি কমায়
ডা. মাহবুব এইচ খান
বর্তমানে সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি লোক দীর্ঘমেয়াদি (ক্রনিক) হেপাটাইটিস বি রোগে আক্রান্ত। আগামী ২০১০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৪০ কোটিতে উন্নীত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বাংলাদেশেও প্রায় ১ কোটি লোক ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগে ভুগছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অনেকে সিরোসিস, লিভার ফেইলিউর, লিভার ক্যানসারের মতো মারাত্মক লিভার রোগে আক্রান্ত হবে, যা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগীদের মধ্যে কারা এসব মারাত্মক পরিণতির শিকার হবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই কষ্টকর। তাই ধরে নিতে হবে যে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগের আক্রান্তের সবাই মারাত্মক লিভার রোগে ভোগার ঝুঁকিতে থাকবে। যেহেতু দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এসব রোগী মৃত্যুমুখে পতিত হয়। তাই রোগাক্রান্তরা পরিবার, সমাজ ও জাতির ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়ান। এক দিকে রোগীর চিকিৎসা খাতে যেমন পরিবার ও দেশকে বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করা লাগে, অন্য দিকে রোগীর জীবনে নেমে আসে হতাশা ও চরম ভোগান্তি। যেহেতু ক্রনিক হেপাইটাইটিস বি রোগীর মধ্যে কোনো রকম রোগ লক্ষণ নাও থাকতে পারে। সেজন্য আক্রান্ত রোগ ছড়িয়ে আক্রান্তদের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়ে তুলবে।
হেপাটাইটিস বি রোগের ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা কমাতে এবং সর্বোপরী এ রোগকে নির্মূল করতে রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অনাক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে প্রতিরোধের কার্যকর পন্থাগুলোর সন্ধানে সচেতন করতে হবে। যে কারণে হেপাটাইটিস বি রোগ একজন থেকে অন্যের মধ্যে সংক্রমিত হয় তার প্রতিরোধ এবং হেপাটাইটিস বি টিকার মাধ্যমে বি ভাইরাসের বিরুদ্ধে সাধারণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি রোগের স্বল্পমেয়াদি জটিলতা (যেমন একিউট লিভার ফেইলিউর) এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা (যেমন-লিভার সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার) ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব। নবজাতক ও শিশু-কিশোরদের হেপাটাইটিস বি টিকা প্রদানের ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি রোগের প্রকোপ ৮ থেকে ১৫ গুণ কমে এসেছে। এ ছাড়া কার্যকর হেপাটাইটিস বি টিকার ফলে তাইওয়ানে ৬ থেকে ১৪ বছরের ছেলে মেয়েদের মধ্যে লিভার ক্যান্সারে আক্রমণের হার বহুলাংশে কমেছে। শুধু তাই নয়, অন্যান্য লিভার অসুখ (যেমন ক্রনিক হেপাটাইটিস সি) রোগে বি টিকা হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের উপর্যুপরি আক্রমণ প্রতিহত করে মারাত্মক লিভার জটিলতায় পড়ার সম্ভাবনাকে তিরোহিত করে। সরকার নবজাতক থেকে ২৯ বছর বয়স্ক সব জনসারণের জন্য বিনামূল্যে হেপাটাইটিস বি টিকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য জনগণকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করা আশু প্রয়োজন। হেপাটাইটিস বি টিকার রোগ প্রতিরোধে শক্তিশালী ভূমিকা থাকায় সবাইকে এই টিকা নেয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানানো হচ্ছে।
লেখকঃ লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ, সিটি হাসপাতাল, সাতমসজিদ রোড, ঢাকা। মোবাইলঃ ০১৭১১৮৫৪৮৩৮