আমরা কোনো কিছু না ভেবেই শুধু দেখেই কাউকে মোটা বা চিকন বলে থাকি। কিন্তু আসলে কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। বডি মাস ইনডে বা বিএমআই নির্ণয় করে কাউকে রোগা বা মোটা বলা হয়ে থাকে। একজন লোকের ওজন কিলোগ্রামে মাপা হয় এবং উচ্চতা মিটারে মাপা হয়। এবার ওজনকে উচ্চতার বর্গফল দিয়ে ভাগ করা হয়। এই ভাগফলকে বলে বিএমআই। বিএমআই ১৮ থেকে ২৪ এর মাঝে হলে স্বাভাবিক। ২৫ থেকে ৩০ এর মাঝে হলে স্বাস্থ্যবান বা অল্পমোটা, ৩০ থেকে ৩৫ এর মাঝে হলে বেশি মোটা। আর ৩৫ এর ওপরে হলে অত্যন্তô এবং অসুস্থ পর্যায়ের মোটা বলা যেতে পারে।
আবার ভুঁড়ির ব্যাপারেও কিছু মাপের ব্যাপার আছে। পূর্ণবয়স্ক পুরম্নষের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক পুরম্নষের কোমরের মাপ ৯৪ সেন্টিমিটার বা ৩৭ ইঞ্চি পর্যন্তô স্বাভাবিক যদি তার উচ্চতা কম হয়। আর লম্বা পুরম্নষের ড়্গেত্রে কোমরের মাপ ১০২ সেন্টিমিটার বা ৪০জ্ঝ২ ইঞ্চি পর্যন্তô স্বাভাবিক।
মহিলাদের ড়্গেত্রে কোমরের মাপ ৮০ মেন্টিমিটার বা ৩১জ্ঝ৫ ইঞ্চি পর্যন্তô স্বাভাবিক ধরা যেতে পারে। তবে মহিলাদের কোমরের মাপ ৮৮ সেন্টিমিটার বা ৩৪জ্ঝ৬ ইঞ্চি থেকে বেশি হলে অত্যন্তô সতর্ক হতে হবে। সুতরাং হুট করেই বিএমআই পরিমাপ বা কোমরের মাপ পরিমাপ না করে বলা যাবে না আপনি মোটা কিংবা আপনার ভুঁড়ি হয়েছে।
শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমার ফলে মানুষ মোটা হয় বা ভুঁড়ি হয়। ফ্যাট সেল বা চর্বি কোষ আয়তনে বাড়ে তখন শরীরে চর্বি জমে। পেটে, নিতম্বে, কোমরে ফ্যাট সেল বেশি থাকে। অতিরিক্ত খাওয়ার জন্য দেহে চর্বি জমে, আবার যে পরিমাণ খাওয়া হচ্ছে বা দেহ যে পরিমাণ ক্যালরি পাচ্ছে সে পরিমাণ ড়্গয় বা ক্যালরি খরচ হচ্ছে না এই কারণেও দেহে মেদ জমতে পারে। এগুলো শোনার বা জানার পর অনেকে হয়তো বলবেন যে তারা যথেষ্ট সঠিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণের পরও ওজন বেশি। তাদের অভিযোগ সঠিক। বংশগত কারণেও মানুষ মোটা হতে পারে। ‘ওব জিন’ নামের এক ধরনের জিন থাকে ফ্যাট সেলের মাঝে। এরা লেপটিন নামের এক রকম হরমোন তৈরি করে। লেপটিন আমাদের মস্তিôষ্কের হাইপোথ্যালামাসে দেহে জমে থাকা চর্বির পরিমাণ জানিয়ে দেয়। হাইপোথ্যালামাস নিউরোপেপটাইড ওয়াই নামে এক রকম।
উৎসেচকের মাধ্যমে মস্তিôষ্কের ড়্গুধা নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রকে উত্তেজিত বা নিস্তেôজ করে আমাদের ড়্গুধাকে নিয়ন্ত্রণ করে। জিনগত ত্রম্নটির কারণে যদি লেপটিন হরমোন কম থাকে তাহলে ড়্গুধা বেড়ে যায় ৈএর ফলেও দেহে মেদ বৃদ্ধি পায়। আবার যাদের দেহে ব্রাউন এডিপোজ টিস্যু বেশি থাকে তারা মোটা হয় না। এছাড়া থাইরয়েড হরমোন মেদ কম বা বৃদ্ধির সাথে জড়িত, থাইরয়েড হরমোন বৃদ্ধি পেলে রোগী প্রচুর খাবে কিন্তু ওজন বাড়বে না। আবার থাইরয়েড হরমোন কমে গেলে ওজন বৃদ্ধি পায়।
মদ্যপান, অতিরিক্ত ঘুম, মানসিক চাপ, স্টেরয়েড এবং অন্য নানা ধরনের ওষুধ গ্রহণের ফলেও ওজন বাড়তে পারে। বাড়তি ওজন কিংবা ভুঁড়ি নিয়ে অনেক সমস্যা। বাড়তি ওজনের জন্য যে কোনো ধরনের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া রক্তনালীতে চর্বি জমে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাড়তি ওজন রক্ত চাপেরও কারণ।
ডায়াবেটিস টাইপ টু দেখা দিতে পারে মেদ বৃদ্ধির জন্য।
মেদবহুল ব্যক্তির জরায়ু, প্রস্টেট এবং কোলন ক্যান্সারের সম্ভাবনা শতকরা পাঁচ ভাগ বেশি।
ওজন বৃদ্ধির সাথে সাথে হাঁটাচলা করতে সমস্যা হয়। হাঁটুর সন্ধিস্থল, কার্টিলেজ, লিগামেন্ট ড়্গয়প্রাপ্ত হয়। আর্থারাইটিস, গেঁটে বাত এবং গাউট হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
অতিরিক্ত চর্বি থেকে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
অতি ওজন এবং ভুঁড়ির জন্য যৌনড়্গমতা কমে যেতে পারে। পুরম্নষের শুক্রাণু কমে যেতে পারে এবং মহিলাদের অনিয়মিত ঋতুস্রাব হতে পারে।
অতিরিক্ত ওজন ও ভুঁড়ির আসলে অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা। আবার দেখতেও যথেষ্ট দৃষ্টিকটু লাগে। কোনো পোশাকেই ভালো দেখায় না। বয়সের তুলনায় বয়স্ক দেখায়, অনেক সময় লোকজন বাজে মন্তôব্য পর্যন্তô করে থাকে। অতিরিক্ত ওজন ও ভুঁড়ি কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে সঠিক খাদ্যগ্রহণ ও ব্যায়াম। কিন্তু দুইটিই অত্যন্তô কষ্টের সাথে নিয়মিত করতে হবে। আজ নয়, কাল করবএৈমন মনোভাব থাকলে চলবে না।
নিয়মিত হাঁটা সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম। প্রতিদিন নিয়ম করে এক ঘণ্টা হাঁটতে পারলে খুবই ভালো। সাইকেল চালানো এবং সাঁতার কাটাও খুব ভালো ব্যায়াম। ভুঁড়ি কমাতে কিছু আসনের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এদের মাঝে ত্রিকোণ আসন, একপদ উত্থান আসন, পবন মুক্তাসন। পশ্চিমোন্থনাসন খুবই কার্যকর।
চর্বি জাতীয় খাবার, মাখন, তেল, গরম্ন, খাসির গোশত এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় কেউ যদি ওজন কমাতে চান তবে ডায়াবেটিশিয়ান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। কেননা ওজন কমাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছেন এমনটাও কিন্তু হয়।
আজকাল অপারেশনের সাহায্যেও ভুঁড়ি কিংবা মেদ কমানো হচ্ছে। লাইপোসাকশন বা অ্যাবডোমিনো পস্ন্যাস্টির সাহায্যে আজকাল মেদ কমানো হচ্ছে।
মেদ ভুঁড়ি যেখানে এত সমস্যা, সেখানে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। মেদ জমতে শুরম্ন করার প্রারম্ভেই সতর্ক হয়ে জরম্নরী পদড়্গেপ নিতে হবে।
প্রতি সপ্তাহে অন্তôত একবার ওজন নিলে ভালো। আবার হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি অসুখের লড়্গণ, তেমনটা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করবেন। পরিমিত খাদ্যাভাস, নিয়মিত শরীর চর্চা আমাদের মেদ ভুঁড়ি থেকে রড়্গা করতে পারে। আরেকটা কথা, মেদ বা ভুঁড়ি কোনোভাবেই সুস্বাস্থ্যের লড়্গণ নয় এবং নানা অসুখের কারণ এ কথা মনে রাখবেন।
স্থূলতা বা মুটিয়ে যাওয়া সমস্যা
ডা. নুশরাত ফারজানা
শরীরের মধ্যে অতিরিক্ত মেদ-চর্বি জমাকেই স্থূলতা বলে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে, একজন ব্যক্তির ওজন তার কাঙ্ক্ষিত বা আদর্শ ওজনের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ বেশি হলে তখন তাকে স্থূলতা বলে। শরীরের ওজন কাঙ্ক্ষিত বা আদর্শ ওজনের চেয়ে শতকরা ২০ ভাগ বেশি হলে তাকে অতিরিক্ত মেদবহুল বলে। স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন দুটো সমার্থক শব্দ।
যদিও দরিদ্র দেশগুলোতে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা, অপুষ্টিতে ভুগছে তবুও উন্নত বিশ্বসহ দরিদ্র দেশগুলোতে উচ্চবিত্তের মাঝে স্থূলতা একটি বড় সমস্যা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্থূল মানুষের সংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে এ কথা বলা যায়ন্ধ উন্নত দেশগুলোতে শহুরে বসবাসকারী ৪০-৫০ শতাংশ মানুষ স্থূলতায় আক্রান্ত। এটা একটি ভুল ধারণা যে, স্থূলতা শুধু উন্নত বিশ্বের মানুষের সমস্যা। উন্নয়নশীল বিশ্বেও এ সমস্যা কম-বেশি আছে।
স্থূলতার কারণঃ স্থূলতার কারণ জটিল ও বহুল। যেকোনো বয়সে স্থূলতা হতে পারে। তবে বয়স বাড়লেই স্থূলতার সমস্যা দেখা দেয়। ছোটবেলায় স্থূলতা দেখা দিতে পারে। ছোটবেলায় স্থূলতা দেখা দিলে বয়স্ক অবস্থায় তা নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়ে। নারী-পুরুষ উভয়ই এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়। তবে যুক্তরাজ্যে নারীদের মধ্যে স্থূলতার হার বেশি। অনেকের স্থূলতা একটা বংশগত ব্যাপার। অনেক সময় হরমোনজনিত কারণেও স্থূলতা দেখা দেয়ন্ধ সুপ্রারেনাল; পিটুইটারি ও থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যায় স্থূলতা দেখা দেয়। শারীরিক পরিশ্রম কম করার ফলেও এ সমস্যা হতে পারে। আমরা যা খাবার খাই তা যদি পরিশ্রমের মাধ্যমে খাদ্যশক্তি (ক্যালরি) খরচা না হয় তবে তা শরীরের চর্বি ব্যাংকে জমা হয়। এই ্ব্যাংক শরীরে বিভিন্ন শাখা স্থাপন করে। বিশেষ করে বিরক্তিজনকভাবে আমাদের শরীরের মধ্যাংশে। অতিরিক্ত খাবারের জন্য বিশেষ করে মিষ্টিজাতীয় খাবারের জন্য স্থূলতা হতে পারে। ৭০-৯০ শতাংশ স্থূলতা হয় অতিরিক্ত ভোজনের জন্য, বাকি ১০ ভাগ অন্য কারণে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সাধারণত সমাজের উচ্চবিত্তের শ্রেণীর মাঝে স্থূলতার হার বেশি।
স্থূলতা কিভাবে বুঝবেনঃ সাধারণত চোখে দেখেই স্থূলতা আন্দাজ করা যায়। তবুও স্থূলতা নির্ণয়ের জন্য কতগুলো নির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে। সেগুলো হচ্ছেন্ধ (১) শরীরের ওজন ও শারীরিক উচ্চতা মেপে ব্যক্তির স্বাভাবিক ওজন, কম ওজন ও স্থূলতা নির্ণয় করা যায়। যখন শরীরের ওজন কাঙ্ক্ষিত বা আদর্শ ওজনের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি হয় তখন তাকে স্থূলতা বলে।
আদর্শ ওজন নির্ধারণ করতে আমেরিকার স্ট্যাডফোর্ড হার্ট ডিজিজ প্রিভেনশন প্রোগ্রাম এই সহজ ফর্মুলা ব্যবহার করেঃ
মহিলাঃ ইঞ্চিতে উচ্চতা ক্ম ৩.৫ পাউন্ড বিয়োগ ১০৮
পুরুষঃ ইঞ্চিতে উচ্চতা ক্ম ৪.০ পাউন্ড বিয়োগ ১২৮ (বৃহৎ কাঠামোর বয়স্ক যোগ ৮%; ক্ষুদ্র কাঠামোর বয়স্ক বিয়োগ ৪%)
(২) চামড়ার পুরুত্ব দিয়ে পরিমাপঃ ‘এক ইঞ্চি ভুঁড়ি চিমটি পরীক্ষা’ যদি আপনি আপনার সবচেয়ে নিচের পাঁজরের অস্থির নিচে ১ ইঞ্চি পরিমাণ ভুঁড়ি চিমটি দিয়ে ধরতে পারেন তবে আপনি স্থূল।
(৩) ব্রুকা ইনডেস্ক (ইড়সধথ-মষনপ)িঃ উচ্চতা (সেন্টিমিটার) বিয়োগ ১০০। উদাহরণস্বরূপন্ধ যদি কোনো ব্যক্তির উচ্চতা ১৬০ সেন্টিমিটার হয়, তাহলে তার আদর্শ শারীরিক ওজন হবে (১৬০-১০০)= ৬০ কেজি।
(৪) কোমর ও নিতম্বের বেড়ের অনুপাতঃ কোমরের বেড় স্থূলতা নির্ধারণে একটি সুবিধাজনক ও সহজ পদ্ধতি। কোমরের বেড় সবচেয়ে নিচের পাঁজরের অস্থি ও কোমরের হাড়ের মাঝখান থেকে নিতে হবে। নিতম্বের ব্যাস মাপতে হবে। যদি কোমর ও নিতম্বের ব্যাসের অনুপাত পুরুষের বেলায় (>১) হয় এবং মহিলাদের বেলায় (>.৮৫) হয় তবে বুঝতে হবে পেটে প্রচুর চর্বি জমেছে।
স্থূলতার জটিলতাঃ মনে রাখতে হবে, স্থূলতা একটি স্বাস্থ্য সমস্যা এবং শারীরিক সুস্থতার জন্য ক্ষতিকর। একজন লোক যত বেশি মোটা হবে তার অতিরিক্ত মেদবহুল শরীরে অতিরিক্ত রক্ত পাম্প করার জন্য হৃদযন্ত্রকে বাড়তি কাজ ও পরিশ্রম করতে হয়। দেহের সর্বত্র পুষ্টি ও অক্সিজেন পৌঁছে দিতে হৃদযন্ত্রটিকে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। তা ছাড়া একজন মেদবহুল ব্যক্তির ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। তার রক্তচর্বির মাত্রা বেশি থাকে। এই তিনটিই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং রক্তচর্বির উচ্চমাত্রা একসাথে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বহু গুণে বৃদ্ধি করে। স্থূল লোকদের মাঝে কোনো কোনো ক্যান্সার (স্তন ও কোলন ক্যান্সার) হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। অতিরিক্ত দৈহিক ওজনের জন্য মেরুদণ্ডের ওপর বেশি চাপ পড়ার জন্য কোমর ব্যথা এবং পায়ের সন্ধিতে ক্ষয়জনিত বাত রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। আমেরিকায় এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, হঠাৎ মৃত্যুর হার স্থূল লোকদের মাঝে স্বাভাবিক ওজনের লোকদের চেয়ে ২০ ভাগ বেশি। তা ছাড়া স্থূল মেদবহুল লোকদের মধ্যে পিত্তের পাথর, বন্ধ্যত্ব, পায়ে ভেরিকোস, শিরারোগ, পেটের হারনিয়া রোগ বেশি দেখা যায়।
স্থূলতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণঃ যেহেতু স্থূলতা কিছু রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান এবং সুস্বাস্থ্য ও সুখের ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী। সেজন্য স্থূলতা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবেন্ধ
(১). অতিরিক্ত ভোজনের অভ্যাস ত্যাগ করুনঃ খাবার যখন খুব মজাদার হয় তখন আপনার বেশি খাওয়ার লোভ হতে পারে। আপনি যত বেশি খাবেন, তত বেশি ক্যালরি আপনি গ্রহণ করছেন। মনে রাখতে হবে, যত বেশি ক্যালরি আপনি গ্রহণ করছেন, তা যদি দৈনন্দিন পরিশ্রমের মাধ্যমে খরচ না হয় তবে তা দেহে চর্বি আকারে জমা হয়।
(২). প্রতিদিন নিয়মিত ব্যায়াম করুনঃ ওজন কমানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলোন্ধ কম ক্যালরি খাওয়া এবং প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করা বা ব্যায়াম করা। প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি আপনি খান তার চেয়ে বেশি যদি পরিশ্রমের মাধ্যমে ব্যয় করতে পারেন, তবে আপনি নিশ্চিতভাবে শরীরের ওজন কমাতে সক্ষম হবেন।
ওজন কমানোর জন্য শুধু ব্যায়াম করলেই চলবে না। অনুরূপভাবে খাবার নিয়ন্ত্রণও এককভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সে জন্য আপনি চমৎকার ফল পাবেন যদি এ দুটো অভ্যাস যার প্রথমটি ব্যায়াম এবং দ্বিতীয়টি খাদ্য নিয়ন্ত্রণ একত্রে অনুশীলন করতে পারেন। প্রতিদিন যে পরিমাণ ক্যালরি আপনি খাদ্যের সাথে গ্রহণ করেন, তার চেয়ে (৫০০) ক্যালরি বা তার বেশি যদি ব্যয় করতে পারেন, তবে প্রতি মাসে এক থেকে দুই কেজি ওজন কমাতে সক্ষম হবেন।
(৩) আলস্য ও কর্মবিমুখ জীবন পরিহার
করুনঃ বসে বসে টিভি দেখা, বসে বসে ইনডোর গেম, আড্ডা ইত্যাদি কায়িক পরিশ্রমহীন বিনোদন কমিয়ে কায়িক পরিশ্রমযুক্ত বিনোদন, খেলাধুলা করতে পারেন। এসবের মধ্যে থাকতে পারে বাগান করা, সাঁতার কাটা, বল খেলা, উদ্যানে ভ্রমণ এবং সাইকেল চালানো ইত্যাদি।
(৪) প্রতিদিনের খাদ্য থেকে চর্বির পরিমাণ কমিয়ে দিনঃ আপনার খাদ্য তালিকা থেকে চর্বিযুক্ত খাবার বাদ দিন। পূর্ণ শস্য দ্বারা প্রস্তুত খাদ্য যথেষ্ট পরিমাণে খান। গরু, খাসির গোশত, মগজ, কলিজা, মাখন, ঘি, ডিমের কুসুম ইত্যাদি পরিহার করুন।
(৫) বেশি করে আঁশযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করুনঃ সবার মধ্যে রয়েছে বিশেষ করে টাটকা ফলমূল, শাকসবজি ও চালনি দিয়ে চালা হয়নি এমন শস্য বা খাবার। আঁশযুক্ত খাদ্য ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে রক্ত-স্রোতে চর্বি ও রক্তচর্বি শোষণ রোধ করে।
(৬) মদ্যপান এবং অনুরূপ পানীয় ত্যাগ
করুনঃ মদ্যপানের অন্যান্য ক্ষতির পাশাপাশি মানবদেহকে মোটা ও মেদসর্বস্ব করে তোলে কারণ তার মধ্যে প্রচুর ক্যালরি রয়েছে। (৭) প্রতিদিন যথেষ্ট পানি পান করুনঃ দৈনিক ৬ থেকে ৮ গ্লাস। ঔষধি চা বা বিশুদ্ধ পানি পান করুন। পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে, ওজন কমাতে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং নিরাপদ উপায় হলো জীবনযাত্রার পরিবর্তন সাধন করা। আপনি যদি খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম ও জীবনযাপনের ধারায় কিছু পরিবর্তন সাধন করতে পারেন তবে আপনি সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারেন। যদিও যত দ্রুত ওজন হ্রাস আপনি আশা করবেন তত দ্রুত হবে না। তবুও পরিবর্তিত ও সুনিয়ন্ত্রিত নতুন জীবনযাত্রা যা আপনি শুরু করেছেন তা বছরের পর বছর কোনো ঝুঁকি ছাড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন। সপ্তাহে আধা কিলো থেকে এক কিলোগ্রাম ওজন হ্রাস করা একটি নিরাপদ ও সঙ্গত লক্ষ্য। যে নতুন অভ্যাস আপনি শুরু করেছেন তা আপনাকে অতিরিক্ত ওজন থেকে আজীবন রক্ষা করবে। ওজন হ্রাস আপনার জীবনকে রক্ষা করবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে যা করবেন
ডাজ্ঝ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক, খুলনা মেডিকেল কলেজ
প্রতিদিন তিনবার খাবার খান
প্রতিদিন তিন বেলা খাওয়ার অভ্যাস করুন। সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার। কোনো বেলা খাবার বাদ দেওয়া ঠিক নয়। কারণ, এতে আপনি এমন ক্ষুধার্ত হবেন যে পরবর্তী খাওয়ার সময় অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলবেন। এ ছাড়া দুবার খাবারের মধ্যে সময়ের পার্থক্য বেড়ে গেলে শরীরের বিপাকীয় প্রক্রিয়া কমে আসে। তাই নিয়মিত খাবার গ্রহণ করুন।
কতটুকু চর্বি আমাদের খাওয়া উচিত
খাবারের চর্বি কমানোর অনেক পদ্ধতি আছে। অধিকাংশ খাদ্য সংস্থা প্রতিদিনের খাবারে ৩০ শতাংশের বেশি চর্বি অনুমোদন করে না।
চর্বির উৎস
আমরা সাধারণত বুঝতে পারি না কতটুকু চর্বি আমরা গ্রহণ করছি। মোটামুটি ৬০ শতাংশ চর্বি আমরা খাওয়ার সময় বুঝতে পারি না (লুকানো চর্বি)। যেসব চর্বি চোখে দেখা যায়, সেগুলো আলাদা করা সহজ; যেমন-মাখন, মার্জারিন ও তেল। আপনি যখন আপনার খাবারের চর্বির পরিমাণ নির্ণয় করতে চাইবেন, তখন চোখে দেখা আর না দেখা উভয় ধরনের চর্বিরই খোঁজ নিন।
চর্বি খান কমিয়ে
জ্ঝ চর্বিতে অনেক ক্যালরি আছে। শর্করা বা আমিষের চেয়ে এর পরিমাণ দ্বিগুণ (প্রতি গ্রামে ৯ ক্যালরি), যেটি একজন মানুষ, যে তার ওজন কমাতে চাইছে, তার জন্য একটি দুঃসংবাদ।
জ্ঝ অন্য ক্যালরির উৎসের চেয়ে চর্বি দ্রুত দেহে সঞ্চিত হয়। তাই চর্বির গ্রহণ কমানোর মাধ্যমে ওজন কমানোর চেষ্টা করতে পারেন।
জ্ঝ যে চর্বি আপনি খাচ্ছেন তা আপনার ওজন বাড়ানো ছাড়াও আরও কিছু ভয়াবহ রোগের আশঙ্কা বাড়াতে পারে। তাই স্মেহজাতীয় খাবার কম গ্রহণ করার মাধ্যমে ওজন কমাতে পারবেন এবং সুস্থও থাকতে পারবেন।
অল্প অল্প করে বারবার খাবেন, অনেকক্ষণ না খেয়ে থেকে অতিরিক্ত ক্ষুধা নিয়ে বেশি খাবার খাবেন না।
জ্ঝ যথাসম্ভব বর্জন করুন ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, ভাজা, তৈলাক্ত খাবার, খাবারের মধ্যবর্তীকালীন খাবার।
জ্ঝ খাবারের শেষে মিষ্টিজাতীয় খাবার খাবেন না। চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার পরিহার করুন বা একেবারে কমিয়ে খান।
জ্ঝ বেশি করে শাকসবজি ও ফলমূল খান। বেশি মাছ খান, চামড়া ছাড়া মুরগি আর কম লাল মাংস খাওয়ার অভ্যাস করুন।
জ্ঝ ডিম ভাজি বা পোচ বাদ দিয়ে সেদ্ধ ডিম খান। একটা পুরো ডিমের বদলে দুটো ডিমের সাদা অংশ খেতে পারেন।
জ্ঝ দুধ-চিনি ছাড়া হলে চা-কফি খেতে কোনো বাধা নেই। কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করতে পারেন।
জ্ঝ রান্নায় বেশি পানি ব্যবহার করুন। তেল, মসলা যতটুকু সম্ভব কমিয়ে দিন।
জ্ঝ রান্নায় তেল কমানোর জন্য ননস্টিক প্যান ব্যবহার করতে পারেন।
জ্ঝ দই, নারকেল, ঘি, ডালডা-এসব দিয়ে রান্না করবেন না। ভুনা খাবার বাদ দিন।
জ্ঝ সারা দিন প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। ছয় থেকে আট গ্লাস। খাওয়ার আগে এক থেকে দুই গ্লাস পানি পান করুন, এতে দ্রুত ও দীর্ঘস্থায়ীভাবে আপনার পেট ভরার অনুভূতি আসবে।
জ্ঝ খাবার গেলার আগে খুব ভালো করে চিবিয়ে নিন।
জ্ঝ যদি সেটা সবজি না হয় তবে রান্নার সময় খাওয়ার অভ্যাস বাদ দিন। খাওয়ার সময় টিভি দেখা, খবরের কাগজ পড়া আর বন্ধু বা পরিবারের অন্যদের সঙ্গে গল্প করা থেকে বিরত থাকুন।
জ্ঝ স্মেহবর্জিত দুধ বেছে নিন কিংবা দুধ জাল দিয়ে ঠান্ডা করার পর সর সরিয়ে নিন।
জ্ঝ সালাদে কোনো মাছ বা মাংসের টুকরো মেশাবেন না। বরং কিছু মসলা যোগ করতে পারেন।
জ্ঝ তাজা ফল খান, কাস্টার্ড বা জুস হিসেবে নয়।
জ্ঝ উচ্চ ক্যালরির খাদ্যগুলো বাদ দিয়ে নি্ন ক্যালরির খাদ্য দিয়ে একটা সুষম খাদ্য তালিকা তৈরি করুন এবং তা মেনে চলুন।
হালকা ব্যায়াম থেকে আস্তে আস্তে ভারী ব্যায়ামের অভ্যাস করুন। অল্প ব্যায়ামও আপনার দেহের অনেক উপকার আনতে পারে।
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করুন। যদি একটানা ৩০ মিনিট শরীরচর্চা না করতে পারেন, তাহলে ১০ মিনিট করে দিনে তিনবার করুন।
প্রথম দিকে টানা ৩০ মিনিট পরিশ্রম করা আপনার জন্য খুব কষ্টসাধ্য হতে পারে।
তাই ব্যায়ামের সময় কিছুক্ষণ বিরতি নিন। খুব ভালো হয়, যদি প্রতিদিন অল্প অল্প করে শারীরিক পরিশ্রমের অভ্যাস করা যায়। সপ্তাহে অন্তত তিন দিন দৈহিক শ্রমের অভ্যাস করুন।
এমন কিছু দিয়ে শুরু করুন, যা আপনার জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে যায়।
হাঁটা সবচেয়ে ভালো। বিকল্প হিসেবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো বা টেনিস খেলার কথা চিন্তা করতে পারেন।
শারীরিক শ্রমের জন্য নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে চলুন।
প্রতিদিন কীভাবে কাজের হিসাব করবেন, তা নির্ধারণ করুন
সকাল-
একটা স্থির বাইসাইকেল ব্যবহার করুন, যখন আপনি খবরের কাগজ পড়েন।
বিছানার পাশে একজোড়া হাঁটার জুতা বা কেডস আর কাপড় রাখুন। অন্য কাজের আগেই সকালে উঠে একটু হেঁটে আসুন।
সারা দিনে-
বাগান করা, গাড়ি/ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, আপনার পছন্দমতো যেকোনো কাজ।
বাড়ির বাঁধাধরা কাজ ফেলে একটু হেঁটে আসুন, এতে আপনার মনে প্রশান্তি আসবে।
নিজের কাজ নিজে করুন। ব্যাগ নেওয়া বা অন্য কিছুতে অন্যের সাহায্য নেবেন না।
গাড়ির জন্য দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বরং গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যান।
অফিসে সারা দিন টেবিলে বসে থাকবেন না। প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর পাঁচ মিনিট হাঁটাহঁটি করুন।
লিফট বা এসকেলেটরের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন।
সম্ভব হলে অফিস শেষে হেঁটে বাড়ি ফিরুন।
দৈনন্দিন জীবনধারার সঙ্গে মানানসই দৈহিক শ্রমের অভ্যাস করুন।
সন্ধ্যা
আপনার টিভি দেখার সময় নিয়ন্ত্রণে রাখুন। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কিছু কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন।
সান্ধ্য ভ্রমণ আপনাকে প্রশান্তি দেবে আর সুনিদ্রা সুনিশ্চিত করবে। ছুটির দিনে বন্ধু কিংবা পরিবারের লোকদের সঙ্গে কিছু ব্যস্ত সময় কাটান। যেমন হাঁটা, সাইকেল চালানো, নৌকা চালানো।