ওষুধে সেরে যাবে ডায়াবেটিস!
ওষুধেই সেরে যাবে ডায়াবেটিস। এ দাবি যশোর শহরের ষষ্টিতলার বাসিন্দা ডা. অমল কান্তি সরকারের। তার আবিষ্কৃত ‘একে ডায়াবেট মাদার’ ওষুধটি সেবন করলে দুরারোগ্য এ ব্যাধি থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, ইতোমধ্যে এ ওষুধ সেবন করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন এমন লোকের তালিকাও দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
গতকাল যশোর প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডা. অমল কান্তি সরকার তার ওষুধ সম্পর্কে বর্ণনা দেন। এ সময় তার আবিষ্কৃত ওষুধ সেবন করে ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি পাওয়া ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর গ্রামের বাদশা মিঞার স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা ও স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল এটিএন বাংলার যশোর প্রতিনিধি শাহানারা বেগম, এডিএম রতন, পদ্মনাভ অধিকারী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ডা. অমল কান্তি সরকার দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ‘একে ডায়াবেট মাদার’ ওষুধটি আবিষ্কার করেছেন। তিনি জানান, তার ওষুধটি খাদ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) থেকে পরীক্ষিত। তার ওষুধ সেবন করে অনেক রোগী সুস্থ জীবনযাপন করছেন। এতে সর্বসাকুল্যে খরচ হবে ৯০০ টাকা।
ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির লড়্গণ ও উপসর্গসমূহ
অধ্যাপক (ডাঃ) এম,এ সামাদ
চিফ কনসালটেন্ট এবং বিভাগীয় প্রধান
কিডনি রোগ বিভাগ, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল
প্রাথমিক অবস্থায় নেফ্রোপ্যাথিতে আক্রান্তô হওয়ার পরও এর কোন উপসর্গ লড়্গ্য করা যায় না। তবে যখন উপসর্গ দেখা যায়, ততদিনে কিডনি অনেকাংশে ড়্গতিগ্রস্তô হয়ে পড়ে। নেফ্রোপ্যাথির প্রধান উপসর্গ- পায়ে পানি এসে পা ফুলে যাওয়া এবং উচ্চ রক্তচাপ। এ সময় পরীড়্গা করলে শতকরা নব্বইভাগ ড়্গেত্রে চোখের জটিলতা ও স্নায়ুর জটিলতা লড়্গ্য করা যায়। সাধারণতঃ ডায়াবেটিস হওয়ার ৫-১৫ বৎসর এর মধ্যেই এ ধরনের জটিলতা দেয়া যায়। প্রস্রাবে প্রচুর অ্যালবুমিন যায় ও রক্তে অ্যালবুমিন কমে আসে। এ পর্যায়ে চিকিৎসায় খুব ভাল ফল না পাবার সম্ভাবনাই বেশি। তাই এমন পর্যায়ে নেফ্রোপ্যাথি নির্ণয়ের চেষ্টা করা উচিত, যখন চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় সম্ভব। এ জন্যে প্রত্যেক ডায়াবেটিস রোগীর প্রস্রাবে “মাইক্রোঅ্যালবুমিন (সরপৎড়ধষনঁসরহ)” যায় কিনা তা দেখতে হবে। প্রতি বছর অন্তôতঃ দুইবার প্রস্রাবের মাইক্রোঅ্যালবুমিন দেখা প্রয়োজন। কোন কিডনি রোগীর প্রস্রাবে পতি লিটারে ২০ মিলিগ্রামের বেশি অ্যালবুমিন গেলেই বুঝতে হবে তার কিডনি আক্রান্তô হয়েছে। এই মাইক্রোঅ্যালবুমিন হল প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিসজনিত কারণে কিডনি আক্রমণের অশনি সংকেত। তবে আনন্দের খবর হল ৈএই পর্যায়ে উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করলে বেশির ভাগ ড়্গেত্রেই চিকিৎসার মাধ্যমে নেফ্রোপ্যাথি নিরাময় করা সম্ভব।
বিলম্বিত নেফ্রোপ্যাথির লড়্গণ ও উপসর্গসমূহ
প্রাথমিক পর্যায়ে যদি ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ নির্ণয় করা হয়, যদি রক্তের সুগার ও রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত থাকে তবে ক্রমান্বয়ে কিডিন ড়্গয়প্রাপ্ত হতে থাকে, ধীরে ধীরে কিডনির কার্যকারিতা লোপ পেতে থাকে এবং নিম্নলিখিত উপসর্গসমূহ ক্রমান্বয়ে দেখা দেয়।
০ প্রস্রাবে অতিরিক্ত অ্যালবুমিন/ প্রোটিন
০ উচ্চ রক্তচাপ
০ গোড়ালী ও পা ফুলা
০ রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
০ রক্তে ইউরিয়া ও ক্রিয়েটিনিন বেড়ে যাওয়া
০ ইনসুলিন-এর প্রয়োজন কমে যাওয়া
০ ড়্গুধা মন্দা, বমি বমি ভাব
০ দুর্বল হয়ে যাওয়া ও রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়া
০ বিনা কারণে গা চুলকানো
এ পর্যায়ে চিকিৎসার মাধ্যমে কিডনি রোগ নিরাময় করা সম্ভব নয়, তবে উপযুক্ত চিকিৎসার দ্বারা ফেইল্যুর বিলম্বিত করা যেতে পারে।
ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি নির্ণয়ের জন্য কি কি পরীড়্গা করা দরকার
প্রস্রাব ও রক্ত পরীড়্গার মাধ্যমে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি নির্ণয় করা হয়
০ প্রস্রাব-মাইক্রো অ্যালবুমিন বেশি গুরম্নত্বপূর্ণ। যদি বিলম্বিত নেফ্রোপ্যাথি (ষধঃব হবঢ়যৎড়ঢ়ধঃযু) হয় তবে ২৪ ঘন্টার প্রস্রাবে প্রোটিনের পরিমাণ দেখতে হবে।
০ রক্ত- গস্নুকোচ, ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, অ্যালবুমিন ও ঐনঅ১ঈ
চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথির চিকিৎসা নির্ভর করে ডায়াবেটিস দ্বারা কিডনি কতখানি ড়্গতিগ্রস্তô হয়েছে তার উপর। ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি ঠেকানোর প্রধান শর্ত রোগীর ডায়াবেটিস পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ ড়্গেত্রে ট্যাবলেট-এর পরিবর্তে ইনসুলিন দ্বারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা শ্রেয়। মনে রাখা অত্যন্তô জরম্নরি তা হল ৈডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও প্রস্রাবে আমিষ নির্গত হওয়ার পরিমাণ কমানোর ব্যবস্থা করতে পারলে নেফ্রোপ্যাথি হওয়া সত্ত্বেও কিডনি ফেইল্যুর হবার প্রবণতা অনেকাংশে কমনো সম্ভব। এই ড়্গেত্রে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য ইউঋঅ ড্রাগ যেমনঃ ক্যাপটোপ্রিল বা এনালাপ্রিল গ্রম্নপের ওষুধকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এ ওষুধকে মাইক্রোঅ্যালবুনেমিয়া কমিয়ে নেফ্রোপ্যাথি নিরাময় করতে পারে। যাদের বেশি মাত্রায় আমি যাচ্ছে, তাদের কিডনি অকেজো বিলম্বিত করতে পারে। এমনকি যাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক তাদের মাইক্রো অ্যালবুমিন নিরাময়ের অঈঊও প্রযোগ করে নিরাময় করা যায়।
তাছাড়া খাবার তালিকায় আমিষের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যাদের শরীরে পানি এসে গেছে তাদের স্বল্প পরিমাণে পানি পান ও লবণ পরিহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, “সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়” অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি নির্ণয় ও তার চিকিৎসা ডায়াবেটিসজনিত কিডনি ফেইল্যুর প্রতিরোধের পূর্বশর্ত।
উপবাসী রক্তে গ্লুকোজের মান
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরীর
কলম থেকে
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
উপবাসী রক্তে গ্লুকোজ মান পরীক্ষা হলো ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য একটি সহজ পরীক্ষা। সহজ, খরচ কম, এই পরীক্ষা বেশ জনপ্রিয়ও বটে। হরমোন ইনসুলিনের কাজকর্মে গলতি হলে বেশ ধরা পড়ে এই পরীক্ষায়।
দীর্ঘ উপবাসে শরীরে নিঃসৃত হয় গ্লুকাগন নামে একটি হরমোন, অগ্ন্যাশয় থেকে। এর প্রভাবে যকৃৎ থেকে গ্লুকোজ উৎসারিত হয়, গ্লুকোজ আসে রক্তস্রোতে। যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের শরীর সাড়া দেয় ইনসুলিন নিঃসৃত করার মাধ্যমে, এতে রক্তে উচ্চমান গ্লুকোজ হওয়া রোধ হয়। যা হোক, কারও শরীর থেকে যদি পর্যাপ্ত ইনসুলিন নিঃসরণ না হয় অথবা শরীর যদি ইনসুলিনে সাড়া না দেয়, তখন উপবাসী রক্তে গ্লুকোজ মান উঁচুতে থেকে যায়।
টেস্ট করা সোজা। ১২-১৪ ঘণ্টা উপবাস থাকার পর ল্যাবরেটরিতে এসে রক্তের নমুনা দেওয়া। সকালে রক্তের নমুনা দেওয়াই নিয়ম।
উপবাসী রক্তে গ্লুকোজ মানের ব্যাখ্যাও সহজ।
রক্তের গ্লুকোজ মান দেখে ডাক্তাররা টেস্ট রেজাল্ট ব্যাখ্যা করেন। পরিমাপ হলোঃ প্রতি ডেসিলিটার রক্তে মিলিগ্রাম পরিমাণ গ্লুকোজ।
উপবাসী রক্ত গ্লুকোজ টেস্ট করে ৭০ মিলিগ্রাম/ডিএল-৯৯ মিলিগ্রাম/ডিএল হলো স্বাভাবিক মান। এই মানকে ১৮ দিয়ে ভাগ করলে মিলিমোল/লিটারে পাওয়া যায়।
১০০ মিলিগ্রাম/ডিএল থেকে ১২৬ মিলিগ্রাম/ডিএল মান হলো প্রাক-ডায়াবেটিসের সূচক।
১২৬ মিলিগ্রাম/ডিএলের ওপরে হলে এই সীমা হলো ডায়াবেটিস নির্ণয়ের সূচনা-মান।
রক্তের গ্লুকোজ মান ৭০ মিলিগ্রাম/ডিএলের নিচে হলে রক্তে গ্লুকোজ মান নিচু (হাইপোগ্লাই সিমিয়া), এই মানও বিপজ্জনক।
ফলাফলগুলো সীমা ছুঁই ছুঁই হলে অন্যান্য পরীক্ষা করতে হতে পারে। যেমন মুখপথে গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (ওজিটিটি), করতে হতে পারে আহারের পর রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা (পিপিপিজি পরীক্ষা)।
ফলাফলগুলো স্বাভাবিক মানে থাকলেও বাড়তি টেস্ট করতে হয় অনেক সময়, ডায়াবেটিসের অন্যান্য ঝুঁকি রয়েছে কি না, যেমন উচ্চ বিএমআই অথবা ডায়াবেটিসের অন্যান্য উপসর্গ রয়েছে কি না।
টেস্ট রেজাল্টেও প্রভাব পড়তে পারে কোনো কোনো সময়ঃ
এক ল্যাবরেটরি থেকে অন্য ল্যাবরেটরিতেও ফলাফলে তারতম্য ঘটতে পারে। একই ল্যাবে বিভিন্ন দিনে ফলাফলের হেরফের হতে পারে। সে জন্য দুটি ভিন্ন দিনে করা দুটি অস্বাভাবিক ফলাফলের গড় নেওয়াটা ঠিক হবে।
রক্তের নমুনা সকালে না টেনে সন্ধ্যায় টানলে ফলাফল কম হতে পারে। আর রক্তের নমুনা টানার পর ল্যাবে রক্ত পরীক্ষার মধ্যবর্তী সময় অতিরিক্ত অতিবাহিত হলে ‘ভ্রান্ত নিচু মান’ পাওয়া যেতে পারে। অন্য কোনো রোগ থাকলে, ব্যক্তিগত অভ্যাস, যেমন ধূমপান ও ব্যায়াম-এসবও প্রভাব ফেলতে পারে ফলাফলের ওপর।
টেস্টের ফলাফল অস্বাভাবিক হলে ডায়াবেটিসের সূচক হতে পারে।
টেস্ট করার সময় এবং ফলাফল ব্যাখ্যার সময় একজন স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মকর্তার রোগীর রোগের পুরো ইতিহাস বিবেচনা করা উচিত।
ফলাফল পাওয়ার পর
ফলাফল যা-ই হোক, রোগী পরামর্শ করবেন পুরো স্বাস্থ্য পরিচর্যা টিমের সঙ্গে-একজন ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, সবার সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, রক্তের এই পরীক্ষা করা হলো কেবল ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্যই নয়, একে প্রতিরোধের জন্যও বটে। উঁচু মান হলে কেবল ইনসুলিন কাজকর্মই নয়, জীবনযাপনের পদ্ধতি, খাওয়া-দাওয়া-এসব বিষয়ও বিবেচনায় আসে।
একজন ব্যক্তির টাইপ ১ বা টাইপ ২, যে রকমের ডায়াবেটিসই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চা ইনসুলিনের কাজকর্মকে আরও সাবলীল ও সুগম করে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ব্যাপারে এ কথা সত্য।
এ ক্ষেত্রে উপবাসী রক্তে গ্লুকোজ টেস্ট হলো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংকেত, হতাশার কারণ নয়।
রক্ত দিতে চাইলে যা জানা দরকার
রক্ত দিতে চাইলে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে। সমকামী বা বহুগামী হলে চলবে না। প্রতি দুবার রক্ত দেওয়ার মধ্যে অন্তত তিন মাস বিরতি থাকতে হবে। রক্ত দিতে চাইলে সুস্থ লোকের মধ্যে যেসব গুণ বা শর্ত থাকতে হবে তা হলো-
রক্তদাতার শারীরিক ওজন কমপক্ষে ৪৫ কেজি হতে হবে।
বয়স অবশ্যই ১৮ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হতে হবে।
রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১২ গ্রাম/ডিএল বা তার বেশি থাকতে হবে।
নাড়ির গতি ও শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকতে হবে।
ওষুধ সেবন ছাড়া রক্তচাপ স্বাভাবিক মাত্রায় থাকতে হবে।
শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ থেকে মুক্ত হতে হবে।
শরীরের যে স্থান থেকে সুই দিয়ে রক্ত নেওয়া হয় সে স্থান চর্মরোগ মুক্ত থাকতে হবে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করে নিতে হবে যে রক্তদাতা রক্তবাহিত রোগমুক্ত।
রক্তদাতার বাহুর বা নি্ন বাহুর সম্মুখভাগ সুইয়ের আঘাতজনিত-চিহ্ন মুক্ত থাকতে হবে। কেননা সুইয়ের আঘাতগ্রস্ত লোক পেশাদার রক্তদাতা বা স্বতঃপ্রণোদিত ব্যথানিবারণী ওষুধ গ্রহণকারী নেশাগ্রস্ত বলে চিহ্নিত।
যেসব রোগ থাকলে রক্তদাতাকে সারা জীবন রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে-
ক্যান্সার, হৃদরোগ, রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা, অকারণে ওজন কমতে থাকলে, ইনসুলিন-নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকলে, হেপাটাইটিস-বি থাকলে, ক্রনিক নেফ্রাইটিসে আক্রান্ত হলে, এইডস সংক্রমিত হলে, বিপজ্জনক আচরণে অভ্যস্ত হলে, যকৃতের রোগী, যক্ষ্মার রোগী, নালিহীন গ্রন্থি আক্রান্ত রোগী, সিজোফ্রেনিয়া (মানসিক ভারসাম্যহীন), লেপ্রসি, মৃগী রোগী, হাঁপানি, পলিসাইথেমিয়া ভেরা প্রভৃতি রোগ থাকলে।
সাময়িকভাবে যারা রক্ত দিতে পারবে না-
গর্ভপাত হলে-ছয় মাসের জন্য; রক্ত গ্রহণকারী-ছয় মাসের জন্য; সার্জারি গ্রহণকারী-১২ মাসের জন্য; বুকের দুধ খাওয়ানো মা-১২ মাসের জন্য (শিশুর জ্নের পর থেকে); টাট্টোমার্কধারী-ছয় মাসের জন্য; চিকিৎসাসম্পন্ন ম্যালেরিয়ার রোগী-তিন মাসের জন্য (এনডেমিক এরিয়ায়); টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগী-১২ মাসের জন্য (রোগমুক্তির পর); বিভিন্ন টিকা গ্রহণকারী-১৫ দিনের জন্য; হেপাটাইটিসে আক্রান্ত পরিবারের সদস্য-১২ মাসের জন্য; রেবিস ভ্যাকসিন-১২ মাসের জন্য (টিকা নেওয়ার পর); হেপাটাইটিস ইমিউনগ্লোবিউলিন-১২ মাসের জন্য।
খেয়াল রাখতে হবে, ত্বকের যে স্থানের শিরা থেকে রক্ত নেওয়া হবে, সে স্থানের কেন্দ্র থেকে পাঁচ সেন্টিমিটার এলাকা পর্যন্ত জীবাণুবিধ্বংসী দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
সুই শিরায় প্রথম প্রচেষ্টায়ই ঢোকাতে হবে।
রক্ত পরিমাণমতো নেওয়ার জন্য রক্তদাতাকে আরামদায়ক ডোনার চেয়ারে বা মাথার নিচে বালিশ দিয়ে শুইয়ে রক্ত সংগ্রহ করতে হবে, একটি আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যে।
রক্ত দেওয়া শেষ হওয়ার পর রক্তদাতার প্রতি কিছুক্ষণ যত্নসহ নজর দিতে হবে এবং অন্তত পাঁচ মিনিট চেয়ার বা বিছানায় শুইয়ে রাখতে হবে রক্তদাতা সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করলেও।
কারণ এ পাঁচ মিনিট তাকে গিডিনেসের মতো একটি বৃহৎ প্রতিক্রিয়া থেকে সুরক্ষা করে।
তারপর আরও ১০ মিনিট একটি রিফ্রেশমেন্ট কক্ষে আরাম-আয়েশে তরল পানীয় গ্রহণ করতে হবে রক্তদাতাকে।
খেয়াল রাখতে হবে, শিরায় সুই ঢোকানোর স্থানে রক্তক্ষরণ বা ত্বকে বিক্রিয়া হচ্ছে কি না, হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
খুব বেশি ব্যথা অনুভূত হলে বরফ লাগাতে হবে।
রক্ত দেওয়ার দিন বেশি করে পানীয় পান করতে হবে এবং বেশি পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ জন্য সামগ্রিক রক্তদান পর্বটি একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত মেডিকেল টিমের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হওয়া অপরিহার্য।
ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুবিধ চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। ওষুধ ছাড়া শুধু খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক শ্রম বা ব্যয়াম হল এর প্রাথমিক স্তôর। কারো কারো এর সাথে মুখে খাবার ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে যে ক’টি অসুখ দীর্ঘস্থায়ী ভোগান্তিô ও মাঝে মাঝে মৃত্যুর ঝুঁকিতে নিপতিত করছে তার মধ্যে অন্যতম হল ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ। ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা আতংকজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। হৃদরোগও তাই। ধারণা করা হচ্ছে যে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারেই অন্তôত একজন ডায়াবেটিসের রোগী থাকবে। ডায়াবেটিস দেহের প্রতিটি সিস্টেমকেই ড়্গতিগ্রস্তô করে। দীর্ঘ দিনের ডায়াবেটিস চোখ, কিডনী, হৃৎপিন্ড, স্নায়ূতন্ত্র, ত্বক, সন্ধি বা জয়েন্ট, প্রজননতন্ত্রসহ দেহের প্রতিটিতন্ত্রই তার স্বাভাবিক কার্যকারিতা হারাবে ৈরোগাক্রান্তô হবে। এর মধ্যে হৃদরোগের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা দু’টোই মারাত্মক। ডায়াবেটিস রোগীরা অধিক হারে ও তীব্রতরভাবে হৃদরোগের শিকার হয়। আমাদের নিচের আলোচনা থেকে তা অনেকটা পরিষ্কার হবো।
যাদের ডায়াবেটিস টাইপ ২ হয়েছে, তাদের উচ্চ রক্তচাপে ভোগারসমূহ সম্ভাবনা আছে। একই সাথে রক্তের লিপিডের অস্বাভাবিকতা, দৈহিক স্থূলতা ইত্যাদিও ২ থেকে ৪ গুণ হারে বৃদ্ধি পায়। সর্বোপরি হৃদরোগ সামগ্রিকভাবে কয়েকগুণ বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আমাদের দেশের টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭০% উচ্চ রক্তচাপ, ৯৭% রক্তে লিপিডের অস্বাভাবিকতা ও ৮০% দৈহিক ওজনজনিত সমস্যায় ভুগে। এসব রোগ একই সূত্রে বাঁধা এমনও মতামত দেয়া হয়। এরূপ বক্রকে মেটাবলিক সিনড্রোম বলে যেখানে, অতিরিক্ত দৈহিক ওজন, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে বেশি মাত্রায় গস্নুকোজ, রক্তনালীতে লিপিড জমাকরণ প্রক্রিয়া ইত্যাদি এক সাথে বিরাজ করে। মেটাবলিক সিনড্রোম ইনসুলিনের কার্যকারিতার প্রতিবন্ধকতার সাথে সংশিস্নষ্ট। তবে এখনও এটা পরিষ্কার করে বুঝা যায়নি যে, মেটাবলিক সিনড্রোম ইনসুলিনের কার্যকারিতার প্রতিবন্ধকতার জন্য হচ্ছে নাকি অতিরিক্ত অস্বাভাবিক লিপিডের জন্য অথবা দু’টোর সমন্বিত ফলাফল। কম বয়সী ডায়াবেটিক রোগীদের ড়্গেত্রে মেটাবলিক সিনড্রোম খুব একটা দেখা যায় না। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাতে এটি বাড়তে থাকে; সীমানা রেখা হল ৬০ বছর বয়স। যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ বছর বয়সী মানুষের ৪০% থেকে ৪৫% কে মেটাবলিক সিনড্রোমে ভুগতে দেখা যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের ৬৫% মারা যায় হৃদরোগ ও স্ট্রোকে। প্রতি ৩ জন ডায়াবেটিস রোগীর ২ জনই হৃরোগে মারা যাবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝে ডায়াবেটিস রোগীরা অ-ডায়াবেটিসদের তুলনায় ২ থেকে ৪ গুণ বেশি হারে হৃদরোগে ভুগছে। মধ্য বয়সীদের বেলাতেও অনুপাত প্রায় একই রকম। মহিলাদের হৃদরোগ কম হবার কারণ হল তাদের যৌন হরমোন ইসফ্রোজেন তাদের জন্য প্রতিরড়্গামূলক কাজ করে। কিন্তু যে সব মহিলা ডায়াবেটিসে ভুগছেন তারা এ প্রতিরড়্গা ব্যবস্থার বাইরে চলে আসেন এবং অধিক হারে হৃদরোগে ভুগেন। ডায়াবেটিসে আরো একটি মারাত্মক ঘটনা ঘটে; ডায়াবেটিস রোগীরা অনেকে হার্ট অ্যাটাকের তীব্র ব্যথা অনুভব করতে পারে না। ফলে চিকিৎসা শুরম্ন করতে দেরি হয়ে যায় বা আদৌ শুরম্ন করা হয় না। এর ফলে তারা মারাত্মক জটিলতায় ভোগে বা অধিক হারে মৃত্যুবরণ করে।
ডায়াবেটিস রোগীদের সামান্য একটু বেশি হারে রক্তের গস্নুকোজ বজায় রাখতে পারলেই যথেষ্ট উপকার পাওয়া যায়। ডায়াবেটিস রোগীর এইচবিএ১সি ১% কমানো গেলেও ডায়াবেটিস সংশিস্নষ্ট মৃত্যুহার ২১% কমবে এবং হার্ট অ্যাটাকের কমবে ১৪%। ডায়াবেটিসে রক্ত চাপ তার সমবয়সী অন্য মানুষদের চেয়ে কম রাখতে হবে। রক্ত চাপ কাংড়্গিত মাত্রায় রাখতে পারলে ডায়াবেটিসজনিত কিডনীর জটিলতা অনেকটাই কমানো যেতে পারে। একই সাথে স্ট্রোক, ডায়াবেটিসে মৃত্যু, হার্ট ফেইলার ও অন্ধত্বের হারও কমবে। জরিপে দেখা গেছে যে, ডায়াবেটিস রোগীর রক্তচাপ ১০ মিজ্ঝমিজ্ঝ পারদ কমানো গেলে ডায়াবেটিস সংশিস্নষ্ট মৃত্যু হার ১৫% কমবে, হার্ট অ্যাটাক কমবে ১১%। ব্যাপক হারে রক্তের লিপিড কমানোর চিকিৎসা করা উপকারী। এড়্গেত্রে হৃদরোগের ঝুঁকি যথেষ্ট কমবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য বহুবিধ চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে। ওষুধ ছাড়া শুধু খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক শ্রম বা ব্যয়াম হল এর প্রাথমিক স্তôর। কারো কারো এর সাথে মুখে খাবার ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। কারো আবার ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। তবে সবড়্গেত্রেই জীবনযাত্রার পরিবর্তন আবশ্যক। জীবন যাপনে শৃংখলা, পরিমিত ও প্রয়োজনীয় পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত ও সঠিক খাদ্যগ্রহণ দৈহিক ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, নিয়মিত ও পরিমিত শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম ইত্যাদি বিষয় সঠিকভাবে মেনে চলতে পারলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও এর জটিলতা কমানো সম্ভব।
০ ডাঃ শাহজাদা সেলিম
ডায়াবেটিক মায়ের নবজাতকের সমস্যা
ডাজ্ঝ ইমনুল ইসলাম
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের নবজাতকদের বিভিন্ন রকম জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বেড়ে চলেছে। মাঝেমধ্যেই শোনা যায়, গর্ভ ধারণ করার পর গর্ভবতী মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন।
কিন্তু আগে তিনি আক্রান্ত ছিলেন না, একে বলা হয় জেসটেশনাল ডায়াবেটিস বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস।
আবার গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন, এমন মাও দেখা যায়।
ডায়াবেটিক মায়ের নবজাতকের জ্ন নেওয়ার সময় আঘাত পাওয়া, সিজারিয়ান অপারেশনের ঝুঁকি ও নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া অন্য স্বাভাবিক মায়েদের নবজাতকদের তুলনায় যথাক্রমে দ্বিগুণ, তিনগুণ ও চারগুণ বেশি দেখা যায়।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের নবজাতক দেখতে বেশ বড়সড়, নাদুসনুদুস, গোলগাল এবং ওজন বেশি হয় (চার কেজির বেশি) শরীরে রক্তের আধিক্য থাকার জন্য, এ নবজাতককে লালবর্ণ দেখায়। এ ছাড়া কানে বেশি রোম থাকে, যা অন্যান্য স্বাভাবিক নবজাতকের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
এসব নবজাতক দেখতে বড় হওয়ার কারণ মায়ের রক্তে গ্লুকোজের আধিক্য, যা কিনা গর্ভফুল দিয়ে গর্ভের সন্তানের পেটে প্রবেশ করে শরীরের বিভিন্ন অংশে গ্লাইকোজেন, প্রোটিন, ফ্যাট আকারে জমা হতে থাকে। তাই এ সন্তানটি দ্রুত বেড়ে ওঠে, জ্নের সময় ওজন বেশি পাওয়া যায়।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের নবজাতকের জটিলতা
গর্ভের শিশুর ওজন বেশি থাকার পরও যদি স্বাভাবিকভাবে জ্নগ্রহণ করে, তাহলে জ্নের পরপরই প্রসবজনিত জটিলতা, যেমন-মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে না কাঁদা, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, কণ্ঠের হাড় ভেঙে যাওয়া, মুখের স্মায়ুর দুর্বলতা, কাঁধের মাংসপেশির দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষ করা যায়।
জ্নের পরপরই নাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর মায়ের কাছ থেকে গ্লুকোজ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, পাশাপাশি নবজাতকের অতিরিক্ত ইনসুলিন নিজ শরীরের গ্লুকোজ ব্যবহার করে ফেলায় নবজাতকের রক্তে হঠাৎ করে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায়।
এ সময় তাৎক্ষণিকভাবে নবজাতককে বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করতে হবে, প্রয়োজনে ইনজেকশনের মাধ্যমে গ্লুকোজ শরীরে সরবরাহ করে নবজাতকের মস্তিষ্ককে স্থায়ী ক্ষতের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
কখনো কখনো এসব নবজাতকের রক্তে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম কমে যাওয়ায় এবং রক্তের আধিক্যের কারণে নবজাতকের মস্তিষ্কে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে বলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে।
রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অন্যান্য নবজাতকের তুলনায় বেশি বেড়ে গিয়ে জন্ডিসের সৃষ্টি করে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের নবজাতকের সময়ের আগে অপরিণত স্বল্প ওজনের শিশু জ্নগ্রহণ করার প্রবণতা বেশি থাকে। এসব অপরিণত শিশুর ফুসফুস অপরিপক্ব থাকায় শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতা থাকে।
এই নবজাতকদের জ্নগত ত্রুটির আশঙ্কা প্রায় দুই থেকে চারগুণ বেশি থাকে। শরীরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-যেমন হৃৎপিণ্ড, কিডনি, স্মায়ুতন্ত্র, খাদ্যনালির বিভিন্ন ত্রুটি দেখা যায়।
চিকিৎসা
হাসপাতালে নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি রেখে এসব শিশুর চিকিৎসা করতে হবে। জ্নগত ত্রুটিগুলোর চিকিৎসা সম্ভব, কিন্তু তা ব্যয়বহুল।
সন্তানের ভবিষ্যৎ
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়ের নবজাতকের জ্নের সময় ওজন বেশি থাকার কারণে পরে ওজন বেড়ে গিয়ে মোটা হয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। এসব নবজাতকের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অন্যান্য শিশুর তুলনায় ১০ গুণ বেড়ে যায়।
গর্ভকালীন ও গর্ভপূর্ববর্তী সময়ে ডায়াবেটিক মায়ের রক্তের গ্লুকোজ সঠিক চিকিৎসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে নবজাতকের এসব জটিলতা ও জ্নত্রুটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের যত্ন
ডা. নওশের আজিমুল হক টিটু
ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাগুলোর মধ্যে পায়ের সমস্যা অন্যতম। অপ্রিয় হলেও সত্য, অনেকেই এই গুরম্নত্বপূর্ণ সমস্যা সম্পর্কে উদাসীন। দুর্ঘটনা বা অন্যান্য কারণে পা হারানোর কথা বাদ দিলে অন্য যেসব কারণে অপারেশন করে পা কেটে ফেলতে হয় তার প্রায় ৫০ শতাংশ ড়্গেত্রেই এর জন্য দায়ী ডায়াবেটিসজনিত পায়ের গ্যাংগ্রীন। অঙ্গহানির কারণে কর্মড়্গমতা কমে যাওয়ায় এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব। এ জাতীয় পায়ের সমস্যার জন্য মূলত দায়ী ডায়াবেটিসজনিত স্নায়ুরোগ ও রক্তনালীর রোগ। এর মধ্যে বেশিরভাগই স্নায়ুরোগের কারণে এবং কিছু ড়্গেত্রে দুটোরই ভূমিকা থাকে। এর সাথে যোগ হয় বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশনের ড়্গতিকর প্রভাব। ডায়াবেটিসজনিত স্নায়ুরোগ যেভাবে পায়ের ড়্গতি করে তা হলো
পায়ের স্নায়ুগুলো ড়্গতিগ্রস্তô হওয়ার কারণে ব্যথা অনুভব করার ড়্গমতা কমে যায়, ফলে একই স্থানে বার বার ছোটখাটো আঘাত (যা কি না রোগীর নজরে আসে না) চামড়ায় ড়্গত সৃষ্টি করে। স্নায়ুরোগের কারণে পায়ের মাংসপেশিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে শরীরের ওজন সঠিকভাবে বহন করতে না পারায় পায়ের আকৃতি কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং এর জন্য পায়ের কোনো কোনো স্থানে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে। ঘাম নিঃসরণকারী গ্রন্থির কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় পায়ের চামড়া শুষ্ক ও খসখসে হয়ে ফেটে যায়। ফলে ইনফেকশনের সুযোগ সৃষ্টি করে। রক্তনালীগুলোর ওপর স্নায়ুবিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় পায়ের সব অংশে প্রয়োজনীয় রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। ডায়াবেটিসজনিত রক্তনালীর রোগ ও পায়ের সমস্যা
ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তনালীতে অতিরিক্ত চর্বি জমার কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে যার জন্য বিশেষ করে পায়ে কোনো ড়্গত সহজে সারতে চায় না। ড়্গেত্রবিশেষে পচন পর্যন্তô ধরতে পারে।
কাদের পায়ের সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি
যাদের ডায়াবেটিসজনিত স্নায়ুরোগ বা রক্তনালীর রোগ আছে। ষ আগে যাদের পায়ে একবার ড়্গত সৃষ্টি হয়েছিল। যাদের পায়ের আকৃতি পরিবর্তন হয়েছে যেমন আঙ্গুল ভাঁজ হয়ে যাওয়া। যাদের পায়ে কোনো স্থানে চাপ পড়ার ফলে কড়া (ঈধষষঁং) পড়ে। যাদের দৃষ্টিশক্তি কম। বয়োবৃদ্ধ রোগী যারা একা থাকেন। যাদের ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ আছে। শারীরিক অসুবিধার জন্য যারা নিজে থেকে পা পরীড়্গা করে দেখতে পারেন না। সর্বোপরি ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতার অভাব।
পায়ের সমস্যা এড়াতে করণীয় প্রতিদিন পরিষ্কার পানিতে পা ধুয়ে নরম তোয়ালে দিয়ে আঙ্গুলের ফাঁকসহ পুরো পা মুছে ফেলুন এবং পরীড়্গা করে দেখুন যাতে ছোটখাটো আঘাত দৃষ্টি না এড়ায়। কারো পা বেশি শুষ্ক থাকলে অলিভওয়েল লাগাতে পারেন। নখ কাটার সময় খেয়াল রাখুন যাতে নখের কোণাগুলো বেশি কাটা না হয়। জুতা পরার আগে অবশ্যই দেখে নেবেন জুতার ভিতরে বা বাইরে আলপিন বা অন্য কিছু আছে কি না। জুতা কেনার সময় হাইহিল ও আঁটোসাঁটো জুতা কিনবেন না।
উত্তপ্ত জিনিস যেমন হট ওয়াটার ব্যাগ ইত্যাদি থেকে পা দূরে রাখুন। ঘরে বা বাইরে খালি পায়ে হাঁটবেন না। ধূমপান পরিহার করম্নন ও কোনো অসুবিধা হলে সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সবশেষে আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং সুষ্ঠু স্বাভাবিক জীবনযাপন করম্নন।
লেখকঃ ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ, ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। ফোনঃ ০১১৯৯৮৩৩৬৭৫
ডায়াবেটিসঃ পরীড়্গা ও প্রতিরোধ
ডায়াবেটিস একটি অতি পরিচিত অথচ সাংঘাতিক ঘাতক ব্যাধি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ডায়াবেটিসে আক্রান্তô রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে জাতীয়ভিত্তিক পরিসংখ্যান বা গবেষণা উপাত্ত পর্যাপ্ত না হওয়ায় ডায়াবেটিক রোগীদের প্রকৃত হার আজো অনির্ণীত।
ডায়াবেটিস একটি জীবনব্যাপী রোগ এবং এর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সংক্রান্তô জটিলতাও বিবিধ। ডায়াবেটিস দুই ধরনের হয়ে থাকে। ধরন-১ বা ইনসুলিন ডিপেন্ডেন্ট বা নির্ভর ডায়াবেটিস এবং ধরন-২ ইনসুলিন আন-ডিপেন্ডেন্ট বা ইনসুলিন অনির্ভর ডায়াবেটিস। প্রথমটিতে অগ্নাশয় বা প্যানক্রিয়াস থেকেই ইনসুলিন হরমোনের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, আর দ্বিতীয়ত দেহকোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি সাড়া দেয় না বা রেজিস্টেন্স তৈরি হয়। ‘ইনসুলিনম্ব হলে নারী-পুরম্নষ নির্বিশেষে সকলের জন্য একটি গুরম্নত্বপূর্ণ হরমোন, যা গস্নুকোজকে ব্যতিক্রমী কিছু কোষ বাদে প্রতিটি দেহকোষে পৌঁছে দেয়ার একমাত্র বাহন। বিশ্বের ডায়াবেটিস আক্রান্তô জনসংখ্যার শতকরা ৯০-৯৫ ভাগ রোগীই ধরন-২ ডায়াবেটিসে ভোগেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ডায়াবেটিসে যাকে অনেক বিশেষজ্ঞ প্রি-ডায়াবেটিস বলে থাকেন, রক্তে গস্নুকোজের পরিমাণ বাড়তে থাকে কোন উপসর্গ ছাড়াই; কিন্তু এই নিঃশব্দ আক্রমণ ধ্বংস করতে থাকে রোগীর প্রতিটি দরকারী অঙ্গ। যেমন বৃক্কে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি, চোখে মায়োপিয়া, হাইপারমেট্রোপিয়া, ছানি, রেটিনোপ্যাথি (চোখের বিশেষ সংবেদী স্তôরের অসুখ যা থেকে নেমে আসতে পারে অন্ধত্ব) স্নায়ুতে নিউরোপ্যাথি (অসহনীয় বেদনাদায়ক রোগ), হৃদরোগ উচ্চরক্তচাপ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসা রক্তনালী ডায়াবেটিসজনিত পায়ের ঘা, কি না হতে পারে ডায়াবেটিস সংশিস্নষ্ট জটিলতা থেকে।
ডায়াবেটিসের পরীড়্গা
অতিরিক্ত পানি পিপাসা কিংবা ঘন ঘন প্রস্রাব করা অথবা কাটা ঘা সারতে দেরি হওয়া, এ সবই ডায়াবেটিসের লড়্গণ! কিন্তু যদি এগুলো দেখা না দেয়? আগেই বলেছি নিঃশব্দ আততায়ী আরো ভয়ঙ্কর! তাই নিজেই আগেভাগে পরীড়্গা করে ফেলুন। বিশেষ করে ত্রিশোর্ধ্বর সবাই।
রক্তের গস্নুকোজ পরিমাপ ৮-১২ ঘণ্টা খালি পেটে থাকার পর সহজ কথায় ভোরবেলা খালি পেটে (ঋধংঃরহম চষধংসধ এষঁপড়ংব) প্রথমবার এবং রক্ত দেবার পর নির্দিষ্ট পরিমাণ গস্নুকোজ মিশ্রিত পানি খেয়ে (এষঁপড়ংব ঈযধষষবহমব ঞবংঃ) ২ ঘন্টা পর আবার পরিমাপ করান।
ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী
তারাই ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন যাদের
ৈ
১জ্ঝ ডায়াবেটিসের পারিবারিক ইতিহাস আছে, ২জ্ঝ অতিরিক্ত ওজন, ৩জ্ঝ কোমর ও তলপেটে অতিরিক্ত মেদ, ৪জ্ঝ ৪জ্ঝ৪৫ বা আরো বেশি বয়স্ক (কারো মতে ৩০ বছর), ৫জ্ঝ রক্তে (ভাল) কোলেস্টেরল কম (<৩৫) ৬জ্ঝ রক্তে ট্রাইগিস্নসারাইড বেশি (>১২৫), ৭জ্ঝ উচ্চ রক্তচাপ, ৮জ্ঝ নিদ্রাহীনতা এবং ৯জ্ঝ ডায়াবেটিক মায়ের গর্ভস্থ শিশু।
শহুরে আধুনিক জীবনযাত্রা এতটাই যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছে যে কায়িক শ্রমের ঘাটতিই বহুলাংশে মেদবহুলের কারণ এবং এর পথ ধরে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিচ্ছে।
প্রতিরোধ পরিকল্পনা
বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞদের মতে, নিচের পরিকল্পনাটি দেরি না করে এড়্গুণি হাতে নিলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস পেতে বাধ্য।
১জ্ঝ এখনই পরীড়্গা করে দেখুন ডায়াবেটিস আছে না নেই। থাকলে অবস্থা কতটা গুরম্নতর সেই মতো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। ২জ্ঝ না থাকলে ৬ মাস পর পর পরীড়্গা করে যান, পাশাপাশি ৩জ্ঝ ওজন ঝেড়ে ফেলুন। ৪। খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনুন ৈস্নেহজাতীয় খাবার একবারে ছেঁটে দিয়ে ভিটামিন ও খনিজ যোগ করম্নন। ৫জ্ঝ ময়দা, চিনি, কোমল পানীয়, অতিরিক্ত মিষ্টি এড়িয়ে চলুন। ৬জ্ঝ সামান্য ব্যায়াম করম্নন যেমন ৈহাঁটা, সাইকেল চালানো, সম্ভব হলে টেনিস বা ব্যাডমিন্টন খেলা বা সাঁতার কাটা। ৭জ্ঝ হিসাব রাখুন ডায়েরিতে প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড ও খাবারের একটু হিসাব রাখুন। এটিই আপনাকে গাইড করবে পরবর্তীতে। ৮জ্ঝ শৃঙ্খলা প্রথম ও শেষ কথা ৈডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্রই শৃঙ্খলা ও কঠোর নিয়মানুবর্তিতা।
০ ডাঃ এনকে নাতাশা
বারডেম হাসপাতাল, শাহবাগ, ঢাকা।
চর্বিযুক্ত খাবার ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়
অধ্যাপক ডাজ্ঝ শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরি সার্ভিসেস
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান ডিয়াগোর একদল গবেষক আবিষ্কার করেছেন যে চর্বিবহুল পশ্চিমা ধাঁচের খাদ্য খেলে বাড়ে ‘টাইপ টু’ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
তাঁদের বক্তব্য, প্রচুর চর্বি খেলে ইনসুলিন উৎপাদনের একটি প্রধান এনজাইমের উৎপাদন ব্যাহত হয়।
পরীক্ষাটি করা হয়েছিল একদল ইঁদুরের মধ্যে। তবে গবেষকদের আশা, ‘এই ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার একটি নতুন পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।’ বলেন গবেষক ডাজ্ঝ জেমে মার্থ।
‘সেল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে এ গবেষণা বিশদভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কেবল উন্নত বিশ্ব নয়, উন্নয়নশীল বিশ্বেও বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। তাদের মধ্যে বেশি হলো টাইপ টু ডায়াবেটিস, আর তাদের মধ্যে অনেকেই মেদস্থূল।
সান ডিয়াগোর গবেষক দল দেখেছে, ইনসুলিন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মূল এনজাইম এহঞ-৪ধ-এর উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে যে একক জিন, এতে গোলযোগ হলে ইনসুলিন উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
গবেষকেরা এরপর দেখিয়েছেন যে বেশি চর্বিযুক্ত খাবার একই রকমের মূল জিনের কার্যকলাপ দমন করতে পারে।
খাওয়ার পর রক্তে বাড়ে গ্লুকোজ; এই সাড়া পেয়ে ইনসুলিন ক্ষরণ হয় স্বাভাবিকভাবে, কিন্তু এনজাইম মান কমে গেলে বিটাসেল থেকে ইনসুলিন ক্ষরণ ঘটে না ঠিকমতো। রক্তের গ্লুকোজ মান নিয়ন্ত্রণে এই ব্যর্থতা থেকে ক্রমে ক্রমে ঘটে টাইপ টু ডায়াবেটিস। গবেষকদের ধারণা, যেসব লোকের টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার বংশানুক্রমিক ধাত রয়েছে, তাদের মধ্যে এহঞ-৪ধ জিনে তারতম্য ঘটে থাকতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, যখন অগ্ন্যাশয়ের বিটাকোষে এহঞ-৪ধ মান থাকে কম, তখন স্বাভাবিকভাবে কোষপ্রাচীর দিয়ে গ্লুকোজ গমন সম্ভব হয় না।
তাই রক্তে গ্লুকোজের মান বাড়লেও অগ্ন্যাশয় এতে সাড়া দেয় না। তাই ইনসুলিন ক্ষরণে ঘাটতি হয়। গবেষক ডাজ্ঝ জেমে মার্থ বলেন, কোনোভাবে যদি এই এনজাইম উৎপাদন উদ্দীপ্ত করা যায়, তাহলে ইতর প্রাণী, এমনকি মানুষের মধ্যেও চর্বিবহুল খাবারের কারণে ঘটা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এই ফলাফল যদি মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়, তাহলে টাইপ টু ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ব্যাপারে নতুন অভিজ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।
পেনিনসুলা মেডিকেল স্কুলের মলিকুলার মেডিসিনের অধ্যাপক এনড্রু হ্যাটার্লে বলেন, মেদস্থূল লোকদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা কেন, এ বিষয়ে উপলব্ধি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং এই গবেষণা এ সম্পর্কে নতুন সূত্রের সন্ধান দিয়েছে।
তবে ইঁদুরের ওপর এ গবেষণা মানুষের মধ্যে সরাসরি প্রয়োগ করা যাবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। মানুষের মধ্যে বংশগত প্রবণতা এবং পরিবেশের প্রভাব-এ দুটোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কী করে টাইপ টু ডায়াবেটিস ঘটানোকে প্রভাবিত করে, এটি বোঝা বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার এবং বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশে টাইপ টু ডায়াবেটিস ঘটার কার্যকারণ সম্পর্ক হতে পারে বিভিন্ন।
মানুষের মধ্যে ডায়াবেটিস ঘটার সঙ্গে বংশগত প্রবণতার বিষয়টি এখনো ধারণার পর্যায়ে।
তবে একটি জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্ট, যা টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো জীবনযাপন; খাদ্য ও শরীরচর্চার অভাব।
খাদ্যবিধির মধ্যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা চিহ্নিত করা গেলে বড় রকমের অগ্রগতি অর্জন করা যাবে।
ডায়াবেটিসে গর্ভধারণের ঝুঁকি
একজন মহিলার ডায়াবেটিস রোগ থাকলে রোগী, রোগীর নিকটাত্মীয় ও সংশিস্নষ্ট চিকিৎসকের বিশেষ গুরম্নত্ব দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, ডায়াবেটিস নেই এমন মহিলা ইচ্ছা করলে যে কোন সময় গর্ভধারণ করতে পারেন, অথচ এ রোগ থাকলে অবশ্যই গর্ভধারণের পূর্বে একজন ‘এন্ডোক্রাইনোলোজিস্ট’-এর পরামর্শ প্রয়োজন। তা না হলে মা ও শিশুর জীবনের মারাত্মক কিছু ঝুঁকি দেখা দেয়।
-গর্ভবতী হবার অন্তôত তিন মাস পূর্ব হতে ডায়াবেটিসের ট্যাবলেট খাওয়া বন্ধ করে ইনসুলিন নেয়া শুরম্ন করা। অনেকে ইনসুলিন নিতে ভয় পান, কারণ তারা ভাবেন, একবার ইনসুলিন নিলে সারা জীবন তা নিতে হয়। অথচ এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ ডেলিভারির পর অন্য কোনো জটিলতা না থাকলে যেখানে ইনসুলিন নিরাপদ, ট্যাবলেট খেয়ে এবং খাবার ও পরিশ্রমের নিয়ম অনুসরণ করে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সাধারণত শিশুর বুকের দুধ খাওয়া চলাকালীন ইনসুলিনের প্রয়োজন দেখা যায়। রৈক্তের হিমোগেস্নাবিন এ ওয়ান সি-এর মাত্রা শতকরা ৬জ্ঝ৫ ভাগ-এর কম থাকলে গর্ভধারণের চেষ্টা করা। গৈর্ভধারণের ৩-৬ মাস পূর্ব হতে ১টি করে ‘ফলিক এসিড’ বড়ি খেতে শুরম্ন করা যা পুরো গর্ভকালীন সময় অর্থাৎ প্রসরের পূর্বদিন পর্যন্তô খেয়ে যাওয়া। এ ওষুধ খেলে স্পাইনাল কডের বিকলাঙ্গতা প্রতিরোধ করা যায়। কারণ গর্ভধারণের পর প্রথম ৩-৪ সপ্তাহে মায়েদের ফলিক এসিডের অভাব হলে তিন ধরনের জন্মগত বৈকল্য দেখা দেয়ঃ ১জ্ঝ স্পাইনা বাইফিডা (শিরদাঁড়ায় ফাঁক থাকা) ২জ্ঝ এনেনসেফালি (মস্তিôষ্ক তৈরি না হওয়া) ৩জ্ঝ এনকেফালোসিল (মস্তিôষ্ক পানির মতো পদার্থ দিয়ে পূর্ণ থাকা)। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ শাক-সবজি খেলে ফলিক এসিড পাওয়া যায়।
উপসংহারে বলা যায়, ‘সুস্থ মা ও শিশুর জন্য রক্তে সুগার স্বাভাবিক মাত্রায় থাকা অত্যন্তô জরম্নরি’ এবং এটি একমাত্র সম্ভব‘ৈসঠিক মাত্রায় ও নিয়মে ইনসুলিন প্রয়োগ, সঠিক খাদ্য নির্বাচন এবং যথাযথ পরিশ্রমের মাধ্যমে।’
সুগার এবং ডায়াবেটিস
সাধারণ এই স্বাস্থ্য সমস্যা ডায়াবেটিস হলে রক্তে বেড়ে যায় শর্করার মান। কখন হয় ডায়েবেটিস? অগ্নাশয় নষ্ট হয়ে শরীর যখন ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না তখন হতে পারে ডায়েবেটিস। একে বলে টাইপ ১ ডায়েবেটিস। আবার শরীরের কোষগুলো যদি ইনসুলিন ব্যবহার করতে অড়্গম হয় এবং অগ্নাশয় ও কম ইনসুলিন উৎপাদন করে, তখনো হতে পারে ডায়েবেটিস। একে বলা হয় টাইপ ২ ডায়েবেটিস। আগে টাইপ ১ ডায়েবেটিসকে বলা হয় তরম্নণকালীন ডায়েবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়েবেটিসকে বলা হত বয়স্কলোকের ডায়েবেটিস। এখন দেখা গেছে, বয়স নির্বিচারে যে কোনো রকমের ডায়েবেটিস হতে পারে। সেজন্য তরম্নণ ডায়েবেটিস বা বয়স্কদের ডায়েবেটিস নামগুলোর আর প্রচলন থাকছে না। টাইপ-১ ডায়েবেটিসকে ইনসুলিন নির্ভর এবং টাইপ-২ ডায়েবেটিসকে ইনসুলিন-অনির্ভর ডায়েবেটিস বলা হচ্ছে। অবশ্য টাইপ-২ ডায়েবেটিসেও ড়্গেত্র ও অবস্থা বিশেষে ইনসুলিন প্রয়োগ করতে হয়।
ডায়েবেটিসের সচরাচর দৃষ্ট যেসব জটিলতা সেগুলো হলঃ চোখের ড়্গতি, স্নায়ুরোগ, কিডনির সমস্যা, অবশ্য হার্টএটাক, স্ট্রোক, হাড় ও পেশীরোগ এবং সংক্রমণের মত সমস্যা ও পুনঃপুনঃ হতে পারে, রোগ জটিল হলে। চিকিৎসা হলে এক সঠিক সময়ে ব্যবস্থাপনা করলে এসব জটিলতা ঘটানো দেরী করানো যায় এমনকি রোধও করা যায়।
কি কারণে হতে পারে ডায়েবেটিস?
ব্যক্তি বিশেষে ডায়েবেটিস কেন হয়, তা অজানা, তবে আছে নানা মত এ ব্যাপারে। গবেষণা চলছে, কি করে এই রোগ হয় তা জানার জন্য। আছে কিছু ঝুঁকি উপাদান, যেমন
ৈ
বৈংশগতি।
Ìৈমদস্থূলতা।
ওৈষুধ।
ভৈাইরাস সংক্রমণ।
বর্তমানে বলা হচ্ছে যেসব খাদ্যের গস্নাইসিমিক ইনডে খুব উঁচু, এসব খাদ্য বেশি বেশি খেলে পরিণতিতে হতে পারে ডায়েবেটিস। যেসব খাবার খাওয়ার পর পরই অন্য খাবারের তুলনায় অনেক দ্রম্নত রক্তের সুগার মান বাড়িয়ে দেয় সেসব খাবারের গস্নাইসিমিক ইনডে উঁচু এমন বলা হয়। তবে এও ঠিক অনেক মানুষ এসব খাবার আকচার খাচ্ছে তবে তাদের ডায়েবেটিস হচ্ছে না।
সুগার ও ডায়েবেটিস
ডায়েবেটিস আছে এমন এক রোগীর জন্য পরামর্শ হল, যেসব খাবারে সুগার বেশি সেসব খাবার পরিহার করা এবং এমন খাদ্যবিধি ও ওষুধবিধি মেনে চলা যাতে রক্তের শর্করা মান থাকে স্বাভাবিক ও সুস্থিত। রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ ভালোভাবে করলে রোগটির জটিলতা অনেক এড়ানো সম্ভব। রোগটির মূল বৈশিষ্ট্য যেহেতু রক্তের সুগার মানের বৃদ্ধি এবং যেহেতু উঁচুমান সুগারকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নামিয়ে আনাই হলো চিকিৎসার প্রধান লড়্গ্য, সেজন্য খাদ্যের শর্করা পরিমাণ এককভাবে এ রোগের জন্য দায়ী নয়।
রক্তে সুগার মান বেড়ে যাওয়া হলো ডায়েবেটিসের পরিণতি, কারণ নয়।
নিউমোনিয়ার কারণ যেমন কফ-কাশ হয়, তেমনি রক্তে সুগার মান বৃদ্ধি ও ডায়েবেটিসের কারণ নয়, পরিণতি মাত্র।
আর একটি কথাঃ এ কথা ঠিক টাইপ-২ ডায়েবেটিস বোধ করতে মেদস্থূলতা এড়ানো প্রয়োজন তবে এজন্য বিশেষ বিশেষ খাদ্য খেলে তা এড়ানো যাবে এমনও নয়। আর সব ডায়েবেটিস রোগী স্থূল একথাও ঠিক নয়। এসব রোগীর ড়্গেত্রে বংশগতি এবং অনাবিষ্কৃত অনেক উপাদান দায়ী থাকতে পারে।
শেষ কথাঃ
দেহের ওজন সুমিত রাখা ছাড়া ডায়েবেটিস প্রতিরোধে খাদ্যবিধি বা অন্য উপায় যে খুব সফল তা নয়। এই রোগ বিকাশের পেছনে যে জীনগত, ইম্যুন ব্যবস্থাজনিত বা অন্যান্য পরিবেশগত উপাদান রয়েছে সেসব সনাক্ত করার জন্য চলছে গবেষণা, বিশেষ করে যেসব লোকের ঝুঁকি বেশি এদের ড়্গেত্রে এ রোগ প্রতিরোধ বেশি জরম্নরী। তবে সুগার সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেলে ডায়েবেটিস হয় এ তথ্যটি অবশ্যই সঠিক নয়।
২৮ ফেব্রম্নয়ারি পালিত হচ্ছে ডায়েবেটিস সচেতনতা দিবস। এ দিন জাতীয় অধ্যাপক মোঃ ইব্রাহীম অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডায়েবেটিক সমিতি। এ দিনটি স্মরণীয় এজন্য যে চিকিৎসা ড়্গেত্রে এ দেশে সেদিন সূচিত হয়েছিল একটি নতুন মাইলফলক।
অধ্যাপক ডাঃ শুভাগত চৌধুরী
ডাইরেক্টর, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস,
বারডেম, ঢাকা।
ডায়্যাবিটিজ রোগের ভেষজ চিকিৎসা
ডাজ্ঝ মোজ্ঝ রেজাউল করিম
চিকিৎসার অর্থ হলো ‘রোগ নিরাময়ে ওষুধাদির ব্যবস্থা’। ডায়্যাবিটিজ নিরাময়ে নানান রকম ওষুধ ব্যবহৃত হয়ে আসছে যেমন-অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি আর ইউনানী থেকে শুরম্ন করে হরেক রকম টোটকা ওষুধ।
আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ধরনের গাছগাছড়া ও লতাপাতা খেয়ে ডায়্যাবিটিজ রোগির রক্তের গস্নুকোজ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলে আসছে। ভারত, পাকিস্তôান, বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, জাপান, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, আফ্রিকা, দড়্গিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ওরকম বেশ কিছু গাছ ডায়্যাবিটিজের বিজ্ঞানসম্মত ওষুধগুলোর পাশাপাশি এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সারা বিশ্বে কমপড়্গে সাতশ’র মতো গাছের পাতা, ছাল, শেকড় ইত্যাদি ডায়্যাবিটিজে শর্করা-নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে জানা গেছে। অবশ্য এর বেশিরভাগই এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এদিকে ইনসিউলিনের কোনো ভেষজ বিকল্প নেই, থাকতে পারেও না। তবে ডায়্যাবিটিজের চিকিৎসায় ব্যবহার হয় তেমন কিছু উদি্ভদে বিভিন্ন মাত্রায় রক্তে শর্করা কমানোর উপাদান রয়েছে।
অবশ্য যে কোনো রোগের চিকিৎসায় ভেষজ ব্যবহারের বড় ধরনের একটা অসুবিধে রয়েছে। সংশিস্নষ্ট রোগে কাজ করে তেমন রাসায়নিক ছাড়া অন্য অনেক রাসায়নিকও ওই ভেষজে থাকতে পারে। বাস্তôবে থাকেও। গাছের পাতা, ছাল বা শেকড় খেয়ে কোনও রোগ সারাতে গিয়ে প্রয়োজনীয় রাসায়নিকটির দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া বেশিরভাগ সময়ই অজানা থাকে। তাই ভেষজ চিকিৎসায় রোগে কর্মড়্গম রাসায়নিকটিকে আলাদা করে বের করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। যেমন সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে পাওয়া অনেক রাসায়নিকের ভেতর থেকে বের করা সম্ভব হয়েছে ম্যালেরিয়ায় কার্যকর ওষুধ কুইনাইন।
বাস্তôবে কোনো রোগে কার্যকর রাসায়নিকটি গাছপালায় থাকে খুবই কম মাত্রায়। রোগের চিকিৎসায় যথেষ্ট মাত্রায় ওই রাসায়নিকটি পেতে প্রচুর পরিমাণে গাছের ছাল-পাতা বা শেকড় খাওয়া দরকার। ব্যবস্থাটি অত্যন্তô অসুবিধেজনক। শুধু তাই নয়, ওই পরিমাণ রাসায়নিকের সাথে অন্যান্য নানান রাসায়নিক শরীরে ঢুকে পড়ে যা থেকে বিভিন্ন ধরনের শরীরী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
ডায়্যাবিটিজের চিকিৎসায় অনেক ভেষজ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু ওগুলোর সব কটিতেই শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী রাসায়নিকটি থাকে খুব সামান্য মাত্রায়। সে উপাদানকে আলাদা করে ওষুধ বানানোর চেষ্টা বেশিরভাগ ড়্গেত্রে বিপুল খরচসাপেড়্গ। ওরকম পরিকল্পনা বাস্তôবসম্মত নয় বলেই পরিত্যক্ত হয় বারবার।
তাছাড়া এখন বাজারে ডায়্যাবিটিজ নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট কার্যকরী ওষুধ আছে। এসব ওষুধের তুলনায় আগে উলেস্নখ করা উদি্ভদগুলোতে থাকা রাসায়নিকের শর্করা নিয়ন্ত্রণে বিশেষ কোনো সুবিধে নেই। যেমন ধরা যাক, এদেশে নানান রোগে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় এমন একটি উদি্ভদ চিরতার কথা। মমোরডিকা চ্যারান্সিয়া নামের এই উদি্ভদে থাকা অ্যালকালয়েড চ্যারান্টিন রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা কমায়। তবে চিরতায় এই রাসায়নিকটি থাকে খুবই অনুলেস্নখযোগ্য পরিমাণে।
বলাবাহুল্য, কোনো ডায়্যাবিটিজের রোগী চিরতা খেয়ে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে তাকে যে বিপুল পরিমাণ চিরতা নিয়মিত খেতে হবে তা কোনো মতে বাস্তôবসম্মত নয়। আবার চিরতায় থাকা সে অ্যালকালয়েডটির তুলনায় অনেক কার্যকরী একক ওষুধ রোগী সেবন করতে পারেন অনায়াসে এবং তা করেনও। সে ওষুধের পাশাপাশি সামান্য চিরতার পানি রোগী নিয়মিত খেতেই পারেন। এতে তিনি মানসিক শান্তিô পেলে সুস্থ জীবনযাপন যে সহজতর হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমাদের দেশে মানুষের মনে গাছ-গাছড়ার রোগ সারানোর ড়্গমতার ব্যাপারে বিশ্বাস খুবই গভীর। সে বিশ্বাসে সামান্য আঘাত না করেও বলা যায়, ভেষজ সব ওষুধের কার্যকারিতা, প্রয়োজনীয় মাত্রা ও শরীরী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গবেষণার অভাবে আজও সঠিকভাবে জানা নেই। কোনো ভেষজকে আধুনিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার জন্য এরকম বৈজ্ঞানিক পরীড়্গা জরম্নরি।
ডায়্যাবিটিজের চিকিৎসায় এদেশে মেথি, উচ্ছে, করলা, রসুন, পেঁয়াজ, জামের বিচি থেকে শুরম্ন করে নানা উদি্ভদের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। বিজ্ঞানসম্মত পরীড়্গা-নিরীড়্গার অভাবে এ বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। ঢাকার বারডেম হাসপাতাল এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদড়্গেপ নিলে দেশবাসী নিশ্চয়ই উপকৃত হবে।
ডায়্যাবিটিজ কখনো সারে না। এ রোগ সারাবার কোনো ওষুধ এখন পর্যন্তô উদ্ভাবন করা যায়নি। তবু ডায়্যাবিটিজের চিকিৎসা চলছে। সে চিকিৎসা রোগ নিরাময়ের জন্য নয়। রোগি যাতে সুস্থ সক্রিয় জীবনযাপন করতে পারেন তার জন্য।
চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য রক্তে শর্করা যাতে স্বাভাবিক মাত্রার কাছাকাছি থাকে তা নিশ্চিত করা। একটা সুস্থ জীবনধারার সঙ্গে এ চিকিৎসা চালিয়ে গেলে এখনি যেমন উপকার পাওয়া যাবে। তেমনি ভবিষ্যতে চোখ, কিডনি, স্নায়ু, হার্ট্ ও বড় বড় ধমনির দীর্ঘস্থায়ী ড়্গতির হাত থেকেও রড়্গা পাওয়া যাবে।
মনে রাখতে হবে, ডায়্যাবিটিজ সারা জীবনের রোগ। তবে আধুনিক ডাক্তারি চিকিৎসায় এ রোগকে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে প্রায় সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
ডায়্যাবিটিজ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চাই-
শরীরের সঠিক ওজন সঠিক খাদ্য ওষুধ ব্যায়াম শৃঙ্খলা শিড়্গা
ডায়্যাবিটিজ নিরাময়ে এখন বহু ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও এর চিকিৎসা নিয়ে প্রায়শঃ বিভ্রাট দেখা দেয়। রোগিরা বিভ্রান্তô হয়ে পড়ে। শুভার্থীরা এতরকমের ওষুধের কথা বলেন যে, তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। যিনি যখন যা বলেন, তারা তখন তাই করেন। অর্থাৎ লোকের কথায় তারা নিজেরাই চিকিৎসা করেন।
অনেকে আবার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন মনে করেন না। এখনও বহু উচ্চশিড়্গিত ও সমাজে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত মানুষকেও বলতে শোনা যায়-‘আমি অ্যালোপ্যাথিক জাতীয় কোনো ওষুধ খাই না’। তারা হোমিওপ্যাথি, গাছ-গাছড়া অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক চিকিৎসায় বিশ্বাসী। এই বিশ্বাসের ফল যে তারা একেবারেই পান না, এমন কথা বলা যায় না। তবে বহুড়্গেত্রে দেখা যায়, তারা বহু ক্লেশ সহ্য করে, ধৈর্য না হারিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চালিয়েও শেষে কাঙিড়্গত লড়্গ্য পৌঁছাতে পারেন না।
ডায়্যাবিটিজে আক্রান্তô বেশ কিছু রোগী প্রথমদিকে ওষুধ খেতে চান না। তারা কমপিস্নমেন্টারি থেরাপি অর্থাৎ অনুপূরক চিকিৎসার আশ্রয় নেন। অনুপূরক চিকিৎসা বলতে প্রধানত বুঝায় রিফ্লেোলজি, অ্যারোমাথেরাপি, হোমিওপ্যাথি, হার্বাল মেডিসিন, যোগ, হিপনোথেরাপি, ম্যাসাজ, অ্যাকিউপাংচার এবং অস্টিওপ্যাথি। এ চিকিৎসা পদ্ধতি মোটেও কোনো সুফল বয়ে আনে না।
ব্রিটিশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন খুব স্পষ্ট করে একটা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেঃ ‘কোনো কমপিস্নমেন্টারি থেরাপিই ডায়্যাবিটিজ সারাতে পারে না। কমপিস্নমেন্টারি থেরাপির কোনো চিকিৎসক যদি বলেন, তিনি ডায়্যাবিটিজ সারাতে পারেন, তাহলে তাঁকে পরিহার করে চলাই উচিত।’ কমপিস্নমেন্টারি থেরাপি করাতে চাইলে সেই সাথে ডায়্যাবিটিজের জন্য ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন (ট্যাবলেট কিংবা ইনসিউলিন), তা বন্ধ করা কোনোমতেই উচিত হবে না। হোমিওপ্যাথির মূল সূত্র হলো, বিষে বিষড়্গয়। হোমিওপ্যাথি সাধারণ স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়ে ডায়্যাবিটিজ বশে আনতে সাহায্য করতে পারে। ডায়্যাবিটিজে অনেক সময় রেটিনোপ্যাথি নামে চোখের যে অসুখ হয়, তার চিকিৎসায় অ্যালোপ্যাথির সঙ্গে হোমিওপ্যাথিও করা যেতে পারে। পায়ে যে ঘা হয়, হোমিওপ্যাথি ও অ্যারোমাথেরাপি তার নিরাময় ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে মনে রাখা দরকার, ডায়্যাবিটিজে যে কমপিস্নমেন্টারি থেরাপিই করা হোক না কেন, তা করতে হবে আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি।
কোনো অবস্থাতেই কোনো উদি্ভদ বা ভেষজ, ডায়্যাবিটিজের বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার বিকল্প হতে পারে না। এমনকি বিকল্প হতে পারে না ইনসিউলিনেরও। বাজারে প্রচলিত ওষুধের তুলনায় ভেষজ ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, এরকম ধারণা বহুল প্রচলিত হলেও তা সত্যের অপলাপ মাত্র।
[লেখকঃ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট]
ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন ডি
খুব ছোটবেলায় বাচ্চাদের ভিটামিন ডি সাপিস্নমেন্ট দিলে পরবর্তী জীবনে টাইপ ১ ডায়েবেটিসের ঝুঁকি কমানো যায়। এ নিয়ে অনেকগুলো গবেষণা বিশেস্নষণ করে ব্রিটিশ গবেষকরা তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণ পেলেন যে, এই ভিটামিনের সাপিস্নমেন্টের সঙ্গে ডায়েবেটিসের ঝুঁকি হ্রাসের রয়েছে যোগাযোগ।
‘আর্কাইভস অব ডিজিজ ইন চাইল্ডহুড’ জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ডাঃ ক্রিস্টোস জিপিটিস নামে শিশু বিশেষজ্ঞ ও মুখ্য গবেষক দেখিয়েছেন জন্ম থেকে শুরম্ন করে যেসব শিশুকে কিছুকাল ভিটামিন-ডি সাপিস্নমেন্ট দেয়া হলো এবং যাদেরকে ১৫-৩০ বছর পর্যন্তô অনুসরণ করা হলো, এদের মধ্যে ডায়েবেটিসের ঝুঁকি কমেছে ২৯%। সাপিস্নমেন্টের পরিমাণ ১০ মাইক্রোগ্রাম বা ৪০০ আইইউ। শিশুদের মাল্টিভিটামিনে তেমন পরিমাণ ভিটামিন-ডি-ই থাকে।
৬,৪৫৫ জন শিশু নিয়ে পরিচালিত তিনটি কেস্কন্ট্রোল স্টাডির উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তার এ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যেসব শিশু সাপিস্নমেন্ট দেয়া হয়েছে, আর যাদের দেয়া হয়নি, এদের তুলনা করলে, যাদের ভিটামিন দেয়া হয়েছিল এদের টাইপ ১ ডায়েবেটিসের ঝুঁকি কমেছিলো ২৯%। ডাঃ জিপিটিস সর্বমোট পাঁচটি গবেষণা বিশেস্নষণ করে দেখেছেন, ভিটামিন-ডি’র মাত্রা বাড়ালে ও নিয়মিত গ্রহণে এর সুরড়্গা গুণ বাড়ে। ডাঃ জিপিটিস তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, শৈশবে ভিটামিন-ডি গ্রহণে পরবর্তী জীবনে টাইপ ১ ডায়েবেটিস থেকে হয় সুরড়্গা। এই নতুন গবেষণায় সম্পর্কটি আরো জোরালো প্রমাণ পেলো।
তবে প্রাপ্ত উপাত্তের মধ্যে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এই নতুন গবেষণা প্রবন্ধে দেখানো হয়নি সাপিস্নমেন্ট ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে কি পরিমাণ ভিটামিন-ডি শিশুরা পেয়েছিলো, শুরম্ন করার সময়ই তাদের মধ্যে কাদের এই ভিটামিন-ডি ঘাটতি ছিলো? জিপিটির বলেন, ভিটামিন-ডি’র চরম ঘাটতিতে যাদের রিকেটস রোগ হয় তাদের টাইপ ১ ডায়েবেটিসের উচ্চঝুঁকি থাকে। তিনগুণ বেশি ঝুঁকি থাকে সাধারণ জনগোষ্ঠীর তুলনায়। বোঝা গেলো, শরীরে ভিটামিন-ডি যত বেশি, টাইপ ১ ডায়েবেটিসের সম্ভাবনা তত কম।
অতীতের গবেষণাও এরকম ফলাফলের দিকেই ইঙ্গিত করেছে। রৌদ্রের কিরণ থেকে যেসব দেশ অনেকটা বঞ্চিত, সেসব দেশের তুলনায় যেসব দেশে রৌদ্রালোক অফুরন্তô, আর শরীরে এজন্য ভিটামিন-ডি উৎপাদন হয় পর্যাপ্ত, সেসব দেশের লোকদের মধ্যে টাইপ ১ ডায়েবেটিস অনেক কম। গবেষণায় দেখা গেছে ইউরোপে, বিলেতে ভিটামিন ডি ঘাটতি নতুনভাবে দেখা দিয়েছে, শিশুদের মধ্যে রিকেটস-এর পুনঃআবির্ভাব ঘটেছে। রৌদ্রালোক থেকে রড়্গার জন্য সানবস্নক ব্যবহার, রৌদ্রালোক কোনো কোনো ঋতুতে কম পড়া এসব উপাদান তো রয়েছেই।
রক্তে ভিটামিন ডি মান কম থাকলে কেবল যে রিকেটস ও টাইপ ১ ডায়েবেটিস হতে পারে তাই নয়, ঝুঁকি থাকতে পারে অটোইম্যুন রোগ যেমন ৈরিউমাটয়েড আথ্রাইটিস ও মালটিপল স্ক্লেরোসিসের মত রোগের। এছাড়া কিছু বিরল তবে গুরম্নতর রোগ কার্ডিও মায়োপ্যাথি গবেষণা থেকে দেখা গেছে ভিটামিন ডি সাপিস্নমেন্ট গ্রহণের রয়েছে যথেষ্ট হিতকরী ফলাফল। হাড় তো মজবুত হয়ই, এতে কমে অনেক ধরনের ক্যান্সারেরও ঝুঁকি। ১৭৯ জন রজঃনিবৃত্তি-উত্তর মহিলাদের ওপর গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে ২০০৭ সালে। দেখা গেছেঃ যেসব মহিলার দিনে ক্যালসিয়াম ও ১১০০ আইইউ ভিটামিন-ডি গ্রহণ করেছেন এদের অন্য মহিলাদের তুলনা ৮০% কম ক্যান্সার হয়েছে।
আমেরিকান একাডেমী অব পেডিয়াট্রিস ছোট্ট শিশুদের জন্য প্রতিদিন ২০০ আইইউ ভিটামিন-ডি সাপিস্নমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেনঃ দুই মাস বয়স থেকে।
অধ্যাপক ডাঃ শুভাগত চৌধুরী
ডাইরেক্টর, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস, বারডেম, ঢাকা।
ডায়াবেটিসের আধুনিক চিকিৎসা
ডাজ্ঝ মোজ্ঝ ফরিদ উদ্দিন
মেডিসিন, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড ও হরমোন বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, অ্যান্ডোক্রাইন মেডিসিন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। এর প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটি সারা জীবনের রোগ, এ রোগ কখনো একেবারে সেরে যায় না। কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এ রোগ থেকে শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন রক্তের সুগার সব সময় নিয়ন্ত্রণে রাখা। এ জন্য চিকিৎসক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও গণমাধ্যম রোগীদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের উপায়
ডায়াবেটিক রোগীর সুগার নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন নয়। রোগী ঘরে বসেই নিজের ব্লাড সুগারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন গ্লুকোমিটার দিয়ে ঘন ঘন রক্তের চিনি বা শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করে। এর জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জানা। যেসব বিষয়ে রোগীদের জানতে হবে তা হলো খাওয়া-দাওয়া, ব্যায়াম, ওষুধ ও সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বোধ।
খাওয়া-দাওয়া
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎকের পরামর্শ অনুযায়ী সময়মতো ও পরিমাণমতো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ডায়াবেটিক রোগীর শরীরের ওজন অতিরিক্ত নয়। বেশির ভাগ রোগীই প্রোটিন ও ফ্যাট স্বাভাবিক চাহিদার চেয়ে কম খেয়ে থাকেন। শুধু শর্করাটা বেশি খাওয়া হয়।
শর্করা কমিয়ে খাবারে শাকসবজির পরিমাণ বাড়ানো দরকার, চিনি ও মিষ্টিজাতীয় জিনিস বাদ দিতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে অহেতুক চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা ডায়াবেটিস হওয়ার আগে যে রকম থাকে, পরেও একই থাকে।
খাওয়া-দাওয়ার নিয়ম মেনে চলার উদ্দেশ্য হলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, স্বাস্থ্য ভালো রাখা ও শরীরের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা। খাদ্য ব্যবস্থার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য একে মেডিকেল নিউট্রিশন থেরাপি বলা হয়।
ব্যায়াম
আমরা জানি, ব্যায়াম সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা পরীক্ষিত। ব্যায়াম মাংসপেশির জড়তা দূর করে, রক্ত চলাচলে সাহায্য করে। শরীরে ইনসুলিনের কার্যকারিতা ও নিঃসরণ বাড়ায়। ডায়াবেটিক রোগীর রক্তের ভালো কলেস্টেরল কম থাকে, যা করোনারি হার্ট ডিজিজ হওয়ার একটি বড় রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকি।
প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করা প্রয়োজন। ডায়াবেটিক রোগীর ব্যায়ামের বিকল্প নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কন্ট্রোল করে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
শিক্ষা
ডায়াবেটিস হলে এ রোগ নিয়েই রোগীকে বাঁচতে হয়। তাই রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা। রোগীকে সাহায্য করার জন্য রোগীর স্বজনদেরও এই রোগ সম্পর্কে জানতে হবে। শিক্ষিত, প্রণোদিত রোগী নিজেই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার দক্ষতা অর্জন করেন, পরবর্তী জীবন ধারা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন এবং জরুরি অবস্থা সহজেই মোকাবিলা করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বর্তমানে ডায়াবেটিসের শিক্ষাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে অন্যতম ব্যবস্থা বলে গণ্য করা হয়।
শৃঙ্খলা
শৃঙ্খলা ডায়াবেটিসের রোগীর জীবনকাঠি। শৃঙ্খলার ব্যাপারে শ্রদ্ধেয় প্রফেসর মোজ্ঝ ইব্রাহিম সব সময় গুরুত্ব দিতেন, রোগীকে জীবনের সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা মেনে চলার উপদেশ দিতেন। যারা শৃঙ্খলা মেনে চলে, তাদের পক্ষে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব সহজ ব্যাপার।
ওষুধ
খাদ্যব্যবস্থা, ব্যায়াম, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা মেনে চলা প্রত্যেক ডায়াবেটিসের রোগীর জন্য অপরিহার্য। এতে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীর প্রথম দিকে অনেকেরই শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস একটি প্রগ্রেসিভ রোগ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুগার নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক ডায়াবেটিসের রোগীর ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হয়। টাইপ-১ রোগীদের বাঁচার জন্য ইনসুলিন অপরিহার্য।
সুগার নিয়ন্ত্রণের জন্য টাইপ-২ রোগীদেরও অনেক সময় ইনসুলিনের প্রয়োজন হয়। আবার এও দেখা গেছে, প্রথম দিকে টাইপ-২ রোগীদের যারা শর্করা বেশি থাকায় ইনসুলিন নিয়েছে, পরবর্তী সময়ে বিনা ওষুধেও তাদের রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকছে।
রোগীর সামগ্রিক অবস্থার ওপর চিকিৎসক ঠিক করে দেন রোগীর কী প্রয়োজন। সাধারণত রোগীরা ট্যাবলেটকে ইনসুলিন গ্রহণের চেয়ে বেশি পছন্দ করে। এখন বাজারে ডায়াবেটিসের বিভিন্ন ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে বেশির ভাগ ডায়াবেটিসের রোগীর শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ইনসুলিন
ডায়াবেটিসের রোগীর রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর ওষুধ হচ্ছে ইনসুলিন। ইনসুলিন ইনজেকশনের মাধ্যমে নিতে হয় বলে অনেক রোগীই ভয় পায়। ট্যাবলেটের চেয়ে এর দাম বেশি।
ইনসুলিনের প্রয়োগ শুরু হয় ১৯২১ সাল থেকে। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ইনসুলিনের ধরন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও অনেক উন্নতি হয়েছে।
এখন আধুনিক ইনসুলিন দিয়ে খাবার সামনে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় না। দাওয়াত খাওয়ার জন্য ইনসুলিন সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় না। এখন উন্নত মানের ইনসুলিন শোয়ার আগে একবার নিলেই হয়। সঙ্গে ট্যাবলেট নাশতার সঙ্গে খেতে হয়।
নতুন ইনসুলিন দিয়ে সহজেই রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় তেমন ব্যাঘাত ঘটে না। এই ইনসুলিনগুলো বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। তবে দাম কিছুটা বেশি।
ইনসুলিন প্রয়োগে নতুনত্ব
ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন নেওয়ার ব্যাপারে বড় বাধা হলো বারবার ইনজেশন দেওয়া। যুগের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে ইনসুলিন প্রয়োগেও এসেছে নতুনত্ব। এখন ইনসুলিন ইনহেলার ও ওরাল স্প্রে হিসেবে পাওয়া যায়।
এতে ডায়াবেটিসের রোগীদের দীর্ঘদিনের আশা পূরণ হয়েছে। এর প্রয়োগ-প্রণালী খুবই সহজ। শর্করা নিয়ন্ত্রণও ভালোভাবে হয়। তবে ধূমপায়ীরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই এখনই ধূমপান ত্যাগ করুন। এই ইনসুলিনের দাম একটু বেশি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও এগুলো পাওয়া যাবে।
কীভাবে বুঝবেন আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে কি না তা দেখার জন্য মাঝেমধ্যে রক্তের শর্করা পরীক্ষা করতে হবে। গ্লুকোমিটার দিয়ে বাড়িতে বসে সহজেই তা করা যায়। এসব ছোট মেশিন অল্প দামে বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। অভুক্ত অবস্থায় রক্তের সুগারের পরিমাণ ছয় মিলি মোল/লিটার এবং খাওয়ার পরে আট মিলি মোল/লিটারের মধ্যে হলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে মনে করতে হবে। রক্তে ঐদঅ১ধ মেপেও নিয়ন্ত্রণের ধারণা করা যায়। ঐদঅ১ধ শতকরা ৭ ভাগের নিচে হলে তিন মাস সুগার ভালো নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।
পর্যবেক্ষণ করা
নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস সুনিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা সম্ভব। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস প্রতিনিয়তই রোগীর জন্য বয়ে আনে সমস্যা। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীকে অন্ধ করতে পারে, পঙ্গু করতে পারে। কিডনি ও হার্টের ক্ষতি করে অকালমৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারে।
এ জন্য মাঝেমধ্যে অবশ্যই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা দরকার।
এ ছাড়া রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। হার্ট, কিডনি ও চোখের কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না তা নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। মনে রাখবেন, প্রাথমিক অবস্থায় সমস্যা ধরা পড়লে সহজেই চিকিৎসা করা যায়। আধুনিক পদ্ধতিতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং সুস্থ, স্বাভাবিক, কর্মময় জীবন উপভোগ করুন।
ডায়াবেটিক প্রতিরোধী ভেষজ চা আসছে
ইউএনবি
শিগগিরই ডায়াবেটিক প্রতিরোধক ভেষজ চা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে পাওয়া যাবে। এই চা উৎপাদন ও বাজারজাতের জন্য গতকাল ফেম ফার্মাসিউটিক্যালস এবং বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিএসআইআরসি) মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফেম ফার্মাসিউটিক্যালসের পক্ষে কোম্পানির চেয়ারম্যান মতিউর রহমান এবং বিএসআইআরসি’র পক্ষে সংস্থার চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. চৌধুরী মাহমুদ হাসান চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
এই চায়ে রয়েছে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর উপাদান কেরোসোলিক এসিড। দেশের হাজার হাজার ডায়াবেটিক রোগীর জন্য এই চা খুবই উপকারী হবে।
ডায়াবেটিসে চোখের সমস্যা
ডাজ্ঝ মোজ্ঝ শফিকুল ইসলাম
সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষুবিশেষজ্ঞ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
চোখের সঙ্গে ডায়াবেটিস রোগের সম্পর্ক খুবই গভীর। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে অন্ধত্বের আশঙ্কা একই বয়সের ডায়াবেটিসমুক্ত লোকের তুলনায় ২৫ গুণ বেশি। ডায়াবেটিস হলে চোখের প্রত্যঙ্গ রেটিনায় যে পরিবর্তন হয়, তা রোগীর গড় আয়ুষ্কালের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অর্থাৎ যিনি ডায়াবেটিস নিয়ে যত দীর্ঘ সময় বাঁচবেন, তাঁর রেটিনায় ডায়াবেটিসজনিত জটিলতার আশঙ্কা তত বেশি বাড়বে। রেটিনার এই জটিলতা বয়স্ক রোগীদের অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ। তা ছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না রাখলে চোখের নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যার পরিণতি অন্ধত্ব।
দৃষ্টির তারতম্যঃ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় দৃষ্টিশক্তির তারতম্য দেখা দেয়। রক্তে চিনির মাত্রা ওঠানামার সঙ্গে দৃষ্টিশক্তির তারতম্য দেখা যায়। রোগী হয়তো একসময় কোনো ক্যালেন্ডার বা ছবি স্পষ্ট দেখছেন আবার অন্য সময় ওই ছবি বা ক্যালেন্ডারটি স্পষ্ট দেখছেন না। অনেক সময় দেখা যায়, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে চশমার পাওয়ার বদলিয়েও স্বস্তি পাচ্ছেন না। এসব ক্ষেত্রে দুই ধরনের রোগী দেখা যায়।
একজ্ঝ নির্ণীত ডায়াবেটিসের রোগী হয়েও ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় জীবন যাপনকারী-চিকিৎসকের পরামর্শ থাকা সত্ত্বেও কিছুটা স্বেচ্ছায় বা কিছুটা অপারগতায় নিয়মিত প্রস্রাব পরীক্ষা, খাদ্যনিয়ন্ত্রণ, ওষুধ সেবন ইত্যাদি শৃঙ্খলার সঙ্গে পালন করছেন না।
দুইজ্ঝ অনির্ণীত ডায়াবেটিসের রোগী; ব্যক্তি জানতেনই না যে তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, চশমা নিতে এসে তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে।
একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। চল্লিশোর্ধ্ব একজন নারী একদিন আমার কাছে এসে চোখ পরীক্ষা করান। উদ্দেশ্য চশমা নেওয়া। চোখের সমস্যা ছাড়া অন্য কোনো অসুবিধা আছে কি না জানতে চাই। তিনি জানান, তাঁর কোনো সমস্যা নেই। চশমা নেওয়ার সপ্তাহখানেক পরই তিনি এসে বললেন, ‘ডাক্তারসাহেব, চশমা আমার মোটেই ভালো লাগছে না, বরং চশমা ছাড়াই ভালো লাগে, ভালো দেখি।’ আবার চোখ পরীক্ষা করা হলো। রোগীর দূরের পাওয়ার যেখানে ছিল +১জ্ঝ৫০ ডিএস, সেখানে পুনরায় পরীক্ষায় দেখা গেল তাঁর কোনো পাওয়ারই লাগছে না। সন্দেহ হওয়ায় ডায়াবেটিস নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করাই। তাঁর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার পর চশমায় প্রদত্ত পাওয়ারে তাঁর দৃষ্টিশক্তির অসুবিধা আর রইল না।
তাই দেখা যাচ্ছে, ঘন ঘন দৃষ্টিশক্তির তারতম্যের শিকার রোগীর ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস থাকা অস্বাভাবিক নয় এবং চশমার পাওয়ার পরিবর্তনের আগে রোগটির সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ দরকার। ছয় সপ্তাহ বা তার চেয়ে বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিসের সন্তোষজনক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নতুন চশমার জন্য পরামর্শ দেওয়া ঠিক নয়।
ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিঃ ডায়াবেটিসজনিত রেটিনার অসুস্থতার নাম ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি। এখানে রেটিনা সম্পর্কে সামান্য বলা দরকার।
আমাদের চোখের তিনটি আবরণ রয়েছে। সবচেয়ে ভেতরের আবরণটির নাম রেটিনা। আমরা রেটিনার সাহায্যে দেখি। দৃশ্যমান বস্তু থেকে আলোকরশ্মি রেটিনায় পড়ে প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। রেটিনা ধারণকৃত ওই প্রতিচ্ছবিটি অপটিক নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে এবং এর জন্যই দৃষ্টির অনুভূতি সৃষ্টি হয়। পরিষ্কার দৃষ্টির জন্য সুস্থ রেটিনা অপরিহার্য। তাই রেটিনা কোনো কারণে রোগাক্রান্ত হলে চোখের মূল কাজে বিঘ্ন ঘটে, যার অন্য নাম অন্ধত্ব। দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার বিষয়টি রেটিনার অসুস্থ অংশের অবস্থান ও মাত্রার ওপর নির্ভরশীল।
সারা বিশ্বে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বয়স্ক রোগী ডায়াবেটিসের জন্য অকাল অন্ধত্বের শিকার হন। যুক্তরাষ্ট্রের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিবছর বয়স্ক নতুন অন্ধ রোগীদের মধ্যে ১৯জ্ঝ১ শতাংশ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত। আমাদের দেশে এ সংখ্যা এখনো অজ্ঞাত। রেটিনোপ্যাথির তিনটি পর্যায় বা ধাপ রয়েছে। এ তিনটি ধাপ রেটিনায় সৃষ্ট জটিলতার তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে নির্ণীত। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের সন্তোষজনক চিকিৎসা সম্ভব। কারণ এ দুটি ধাপে রেটিনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কিন্তু তৃতীয় ধাপটির চিকিৎসা বেশ কঠিন। এ ধাপটির শুরু এক ধরনের নতুন, দুর্বল অস্বাভাবিক রক্তনালিকার উদ্ভব দিয়ে। এসব রক্তনালিকা ক্ষণভঙ্গুর। ফলে রেটিনায় প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণের জন্য নতুন নতুন স্থান আক্রান্ত হয়। এসব আক্রান্ত স্থানে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তা সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। ডায়াবেটিসের দীর্ঘ সময় অবস্থানের জন্য শরীরের কোষকলার জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য রেটিনোপ্যাথি দেখা দেয়। তবে রেটিনোপ্যাথির এক ধাপ থেকে অন্য ধাপে রূপান্তর ডায়াবেটিসের অনিয়ন্ত্রণ ও তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে রূপান্তর অবশ্যই বিলম্বিত হবে। কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত না হলে প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপে কিংবা দ্বিতীয় ধাপ থেকে তৃতীয় ধাপে রেটিনোপ্যাথির রূপান্তর স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘটতে পারে। ডায়াবেটিসের তীব্রতা প্রসঙ্গেও একই কথা প্রযোজ্য। রেটিনোপ্যাথির জটিলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য ডায়াবেটিসের সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ জরুরি। নির্দিষ্ট সময়ে শরীরের চেকআপ, রক্তে চিনির মাত্রা নির্ধারণ ও চোখ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। ইনসুলিন-নির্ভর নন এমন রোগীদের ডায়াবেটিস নির্ণীত হওয়ার পাঁচ বছর পর থেকে প্রতিবছরই চোখ পরীক্ষা করানো উচিত।
ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইনসুলিন
অধ্যাপক ডাজ্ঝ জাফর এ লতিফ
ডায়াবেটিস ও এনডোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা।
ডায়াবেটিসের রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বিকল্প নেই। আর এর জন্য প্রয়োজন শৃঙ্খলা, ব্যায়াম, খাবার ও ওজন নিয়ন্ত্রণ। যদি এসবের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তা হলে এর সঙ্গে ওষুধ ও ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়।
ইনসুলিন সাধারণত ত্বকের নিচে ইনজেকশনের মতো করে নিতে হয়। ইনসুলিন নেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রাখা। রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ইনসুলিনের মাধ্যমে করা ভালো ও সহজ। সঠিকভাবে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ করলে রোগীরা ডায়াবেটিসের বিভিন্ন জটিলতা যেমন-অন্ধত্ব, কিডনির জটিলতা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ডায়াবেটিক ফুট প্রভৃতি জটিলতা প্রতিরোধ করতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সাধারণ ইনসুলিনের পাশাপাশি বিশ্বমানের আধুনিক ইনসুলিনও পাওয়া যায়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংপদ্ধতিতে তৈরি এই আধুনিক ইনসুলিনগুলোকে অ্যানালগ বা ডিজাইনার ইনসুলিনও বলা হয়। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় এই আধুনিক ইনসুলিন বিশেষ পরিবর্তন এনেছে। এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকে করেছে অনেক সহজ ও কার্যকর। তাই বিশ্বে আধুনিক ইনসুলিনের ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বে ব্যবহৃত ইনসুলিনের ৫০ শতাংশই আধুনিক ইনসুলিন।
আধুনিক ইনসুলিনের প্রয়োজনীয়তা
যাঁরা ডায়াবেটিসের সাধারণ হিউম্যান ইনসুলিন ব্যবহার করেন, তাঁদের অনেকেরই খাওয়ার পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি পাওয়া যায়। এর কারণ হলো হিউম্যান ইনসুলিন ত্বকের নিচে নেওয়ার পর আস্তে আস্তে রক্তের মধ্যে মিশে। যে কারণে সাধারণ হিউম্যান ইনসুলিনের ক্ষেত্রে খাবার গ্রহণের অন্তত ৩০ মিনিট আগে তা নিতে হয়। দেখা যায়, অনেক ডায়াবেটিসের রোগী এ নিয়মে ইনসুলিন নেন না। ফলে রক্তের গ্লুকোজ সঠিক ও কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ হয় না। এতে ডায়াবেটিসের রোগীরা হাইপোগ্লাইসেমিয়াসহ ডায়াবেটিসের দীর্ঘস্থায়ী অন্যান্য জটিলতায় আক্রান্ত হন।
অন্যদিকে মডার্ন ইনসুলিন ত্বকের নিচে নেওয়ার পর অল্প সময়ের মধ্যেই রক্তে মিশে কাজ শুরু করে। তাই এটি নেওয়ার পর ডায়াবেটিসের রোগীদের খাবার গ্রহণ করার জন্য ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা আধুনিক ইনসুলিন গ্রহণের মাধ্যমে সঠিক ও কার্যকরভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করতে পারবেন।
ইনসুলিন-ই ডায়াবেটিসের প্রথম চিকিৎসা
ডাজ্ঝ মোজ্ঝ ফারুক পাঠান
সহযোগী অধ্যাপক, এনডোক্রাইন মেডিসিন
বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা
ইনসুলিন হচ্ছে ডায়াবেটিস চিকিৎসার একটি অন্যতম উপায়, যা শর্করা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। যেহেতু ডায়াবেটিসের কোনো নিরাময় নেই, তাই রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করাই হলো এর চিকিৎসার একমাত্র উদ্দেশ্য। শর্করা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ডায়াবেটিক রোগী বিভিন্ন ধরনের জটিলতা যেমন-মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্মায়ুরোগ, কিডনি সমস্যা ও চোখের সমস্যায় ভুগে থাকেন। এসব জটিলতা থেকে মুক্ত থাকতে হলে শর্করা নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। শুধু চিকিৎসার মাধ্যমেই সফলভাবে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। চিকিৎসার উদ্দেশ্য হলো রক্তে শর্করার পরিমাণ খাওয়ার আগে ৬ মিলিমোল বা লিটার, খাওয়ার পর ৮ মিলিমোল বা লিটার এবং ঐদঅ১ধ শতকরা ৭ ভাগের মধ্যে রাখা।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার জন্য যে দুটো বিষয় বেশি দায়ী, তার অন্যতমটি হলো প্যানক্রিয়াসের বিটা সেল থেকে যে ইনসুলিন তৈরি হয় তার সেল বা কোষের সংখ্যা কমে যাওয়া অথবা তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। এর ফলে দেখা যায় সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়ার পরও ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে প্যানক্রিয়াস ইনসুলিন তৈরি করার ক্ষমতা প্রায় হারিয়ে ফেলে। বর্তমানে ডায়াবেটিসের যে চিকিৎসা রয়েছে, তার মাধ্যমে শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বিটা সেল যে ধ্বংস বা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে অথবা এর কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে, এর জন্য এখনো কোনো চিকিৎসা উদ্ভাবন হয়নি। ফলে যে কারণে সেল ধ্বংস হচ্ছে তার কোনো চিকিৎসাই করা যাচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে যে চিকিৎসাই দেওয়া হোক না কেন, একসময় শুধু ইনসুলিন দিয়েই চিকিৎসা করতে হয়। অবস্থা যদি তখন এ রকম হয় যে রোগীর খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, কায়িক পরিশ্রম বাড়ানো, ট্যাবলেট ইত্যাদির মাধ্যমেও শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এবং শেষ পর্যন্ত ইনসুলিন দিয়েই চিকিৎসা করতে হচ্ছে, তাহলে প্রথম থেকে ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা করাটাই কি ভালো নয়? গবেষকদের মতে, যত তাড়াতাড়ি ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যাবে, তত বেশি প্যানক্রিয়াসকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখা যাবে এবং বিটা সেলকে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে। ইনসুলিন শুধু যে সঠিক মাত্রায় শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে তা নয়, সেই সঙ্গে বিটা সেলকে কর্মক্ষম রেখে ধ্বংসের হাত থেকেও রক্ষা করে। তাই বলা যায়, ডায়াবেটিস চিকিৎসায় ইনসুলিন হচ্ছে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা। এর মাধ্যমে রক্তের শর্করা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যা ট্যাবলেটের মাধ্যমে সম্ভব নয়। ডায়াবেটিক রোগীর চিকিৎসা যত তাড়াতাড়ি ইনসুলিন দিয়ে করা হবে, ততই তা রোগীর জন্য মঙ্গলজনক হবে। তাই বলা যায়, ডায়াবেটিক রোগীর জন্য ইনসুলিন শেষ চিকিৎসা নয়, বরং প্রথম চিকিৎসাই হওয়া উচিত। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন এর সর্বশেষ পরামর্শও হলো, সম্ভব হলে প্রথম থেকেই ইনসুলিন শুরু করা।
বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন বাজারে রয়েছে। এর রাসায়নিক গঠন পরিবর্তনের মাধ্যমে কোনোটিকে স্বল্পমেয়াদি, কোনোটিকে মাঝারি আবার কোনোটিকে দীর্ঘমেয়াদি করে তৈরি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য সারা দিনের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা। এসব ইনসুলিন চিকিৎসক রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার জন্য উপযোগী নির্দিষ্ট মাত্রা দিনে দুবার অথবা তিনবার আবার অনেক ক্ষেত্রে দুই ধরনের ইনসুলিনই মিলিয়ে দিয়ে থাকেন। স্বাভাবিকভাবে আমাদের শরীরে যেভাবে ইনসুলিন তৈরি হয়, আগে এ সম্পর্কে সঠিক কোনো ধারণা ছিল না। তাই প্রচলিত ইনসুলিনগুলো দিয়ে এ প্রতিস্থাপন সঠিকভাবে সম্ভব হচ্ছে না।
স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেহে দুই ধরনের ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। অভুক্ত অবস্থায় শরীরের নিজস্ব যে গ্লুকোজ তৈরি হয় শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে রক্ষা করার জন্য, সেই গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সারা দিন অভুক্ত থাকলেও এক ধরনের ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। এই ইনসুলিনকে বলা হয় বেসাল ইনসুলিন। সুস্থ দেহে শূন্য দশমিক পাঁচ ইউনিট থেকে এক দশমিক শূন্য ইউনিট প্রতি ঘণ্টা হিসাবে এটা নিঃসরিত হয়ে থাকে প্যানক্রিয়াস থেকে অভুক্ত অবস্থায় শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আবার আমরা যখন খাবার খাই, তা যে খাবারই হোক না কেন বা যে পরিমাণই হোক না কেন, শরীরে সেই খাবার গ্লুকোজ হিসেবেই জমা হয়। খাওয়ার পর সে গ্লুকোজ রক্তে আসে, তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্যানক্রিয়াস থেকে আরেকভাবে ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। এই ইনসুলিন যে পরিমাণ গ্লুকোজ রক্তে আসে, ঠিক সেই হারে রক্তের গ্লুকোজের সমতা রক্ষার জন্য নিঃসরিত হয়ে থাকে। এই ইনসুলিনকে বলা হয় বোলাস ইনসুলিন, যা খাবারের পরের গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করে। একজন সুস্থ মানুষের দেহে এ দুই ধরনের ইনসুলিন সঠিক মাত্রায় তৈরি হলেও ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে এর ঘাটতি দেখা দেয়, যার ফলে তাদের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই নতুন ধারণাকে মাথায় রেখে ইনসুলিন সরবরাহের ক্ষেত্রে নতুন করে ইনসুলিন মলিকিউল তৈরি করা হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে এই ধরনের ইনসুলিন পাওয়া যাচ্ছে। আশার কথা হলো, আমাদের দেশের বাজারেও এ ধরনের ইনসুলিন আসা শুরু হয়েছে। সারা দিনের অভুক্ত অবস্থায় যে ইনসুলিন প্রয়োজন (বেসাল ইনসুলিন), সেটা এখন বাংলাদেশের বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের চিকিৎসকেরা এর ব্যবহার শুরু করেছেন এবং উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের রোগীরাও ভালো ফলাফল পাচ্ছেন। এ ইনসুলিন সারা দিনে একবার গ্রহণ করে ২৪ ঘণ্টায় আমাদের শরীরে অভুক্ত অবস্থায় যে পরিমাণ ইনসুলিনের প্রয়োজন, তার ঘাটতি পূরণ করা যায়। তবে এটা দিয়ে খাবারের পর যে শর্করা তৈরি হয়, সেটা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। ফলে খাওয়ার পর রক্তের বাড়তি শর্করাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ইনসুলিন (বোলাস ইনসুলিন) দরকার, তার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সুখবর হচ্ছে, এ ধরনের ইনসুলিনও এখন আমাদের বাজারে আসা শুরু হয়েছে; যার মধ্যে আরও ভালোভাবে খাওয়ার পরের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। যেটা আগের ইনসুলিন দিয়ে সম্ভব ছিল না; এটাই হলো বোলাস ইনসুলিনের কার্যকারিতা, যার ফলে সঠিকভাবে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং রক্তে শর্করার স্বল্পতা অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিয়া কমানো সম্ভব। এ ধরনের ইনসুলিন দিনে দুই থেকে তিনবার এবং খাবার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নেওয়া যাবে। সে জন্য আমরা যদি একই সঙ্গে বেসাল ও বোলাস ইনসুলিন ব্যবহার করি, তাহলে অভুক্ত অবস্থায় এবং খাওয়ার পরে শরীরে ইনসুলিন সরবরাহ সুস্থ মানুষের মতো সঠিকভাবে করা সম্ভব। ফলে চিকিৎসার যে উদ্দেশ্য অর্থাৎ রক্তের শর্করাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং এর মাধ্যমে উদ্ভূত বিভিন্ন জটিলতা থেকে শরীরকে রক্ষা করা, তা-ও সহজ হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
ডায়াবেটিস স্বল্পকালীন চিকিৎসায় পুরোপুরি সেরে যাওয়ার মত অসুখ নয়। এটিকে সারা জীবন ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধ ছাড়া নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামই কখনও কখনও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট।
যে কয়টি অসুখ মানুষের দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তôীর সৃষ্টি করে তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। সারা বিশ্বেই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উলেস্নখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে রক্তে গস্নুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে শরীরে ডায়াবেটিস-এর উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে থাকে। ইনসুলিনের অভাব হলে শরীরে শর্করা, আমিষ এবং চর্বিজাতীয় খাবারের বিপাক যথাযথভাবে সংঘটিত হতে পারে না। এতে শরীরে পানি ও ইলেক্ট্রোলাইট-এর স্বাভাবিক সমতাও বিনষ্ট হয়। দীর্ঘমেয়াদী অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস শরীরের প্রায় প্রতিটি তন্ত্রকেই ড়্গতিগ্রস্তô করতে পারে। তবে বেশীর ভাগ ড়্গেত্রে কিডনী, হৃৎপিন্ড, চোখ, কান, ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র, অস্থিসন্ধি এবং প্রজননতন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যড়্গমতা ব্যহত করে থাকে। ডায়াবেটিস শরীরের রোগ প্রতিরোধ ড়্গমতা কমিয়ে দেয় এবং ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কখনও কখনও স্ট্রোক, অন্ধত্ব অঙ্গহানি কিংবা মৃত্যুর মত মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করে।
সংক্রামক রোগের মত ডায়াবেটিস-এর সুনিদিষ্ট কোন কারণ জানা যায়নি। তবে বংশগতি বা পারিবারিক প্রবণতা, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স, অধিক মাত্রায় খাদ্যগ্রহণ, মুটিয়ে যাওয়া, রক্তে ড়্গতিকর চর্বি বেড়ে যাওয়া, গর্ভাবস্থা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, কম শারীরিক পরিশ্রম তথা সার্বিক জীবন-যাপনের ধরনের সঙ্গে ডায়াবেটিস-এর নিবীড় যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। পূর্বে উলেস্নখিত বিষয়গুলো ডায়াবেটিস-এর ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে ওজন বেড়ে যাওয়াকে ডায়াবেটিস-এর অন্যতম প্রাথমিক কারণ হিসেবে ধরা হয়। তাই জীবন যাপনের ধরন পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
ডায়াবেটিস-এর চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদী যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের একটি পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে চিকিৎসার পাশাপাশি এর প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অধিকমাত্রায় ক্লান্তিô বোধ করা ডায়বেটিসের সাধারণ উপসর্গ। কখনও কখনও ডায়াবেটিস থাকা সত্ত্বেও এসব উপসর্গ অনুপস্থিত থাকতে পারে। কারও ডায়বেটিস-এর লড়্গণ থাকলে কিংবা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারও ডায়াবেটিস থাকলে রেজিষ্টারড চিকিৎসকের পরামর্শ মত ডায়াবেটিস নির্ণয়ের ল্যাবরেটরী পরীড়্গা করতে হবে। এতে আগেভাগে ডায়াবেটিস নির্ণয় করে এবং নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে ডায়াবেটিস-এর মারাত্মক সব জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে। ডায়াবেটিস-এর কারণ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কার্যকর স্বাস্থ্যশিড়্গার মাধ্যমে ডায়াবেটিস-এ আক্রান্তô ব্যক্তিদেরকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ তথা সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতি বছর ২৮শে ফেব্রম্নয়ারি “জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস” হিসেবে পালিত হয়। এ দিবসটির উদ্দেশ্য হচ্ছে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করে এর প্রতিরোধ এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ বাস্তôবায়ন করা।
ডায়াবেটিস স্বল্পকালীন চিকিৎসায় পুরোপুরি সেরে যাওয়ার মত অসুখ নয়। এটিকে সারা জীবন ধরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানাবিধ কার্যকরী ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধ ছাড়া নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়ামই কখনও কখনও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট। এর সাথে কারও কারও মুখে খাওয়ার ওষুধ-এর প্রয়োজন হয়। কারও আবার প্রয়োজন হয় ইনসুলিন ইনজেকশনের। তবে সকল ড়্গেত্রেই নিয়ন্ত্রিত এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপন আবশ্যক। ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে এবং ডায়াবেটিস-এর জটিলতামুক্ত সুন্দর জীবনের অধিকারী হতে নিচের টিপসগুলো মেনে চলা প্রয়োজনঃঃ
১· আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত সুষম খাবার গ্রহণ করম্নন।
২· অতিরিক্ত লবণ ও চর্বিজাতীয় খাবার যথাসম্ভব পরিহার করম্নন। প্রতিদিন কিছু পরিমাণ শাক-সবজি ও ফলমূল খান।
৩· ফাস্ট-ফুড এবং কোল্ড-ড্রিংক্স পরিহার করম্নন। প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করম্নন।
৪· বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত রিচ ফুড যথাসম্ভব পরিহার করম্নন।
৫· ওজন নিয়ন্ত্রণের চমৎকার একটি উপায় হচ্ছে হাঁটা। তাই কম দূরত্বের জায়গাগুলোতে হেঁটে চলাচল করম্নন।
৬· লিফ্ট-এর বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করম্নন।
৭· একটানা অধিক সময় বসে কাজ করবেন না। কাজের ফাঁকে উঠে দাঁড়ান। একটু পাঁয়চারি করম্নন।
৮· অলসতা দূর করতে সংসারের টুকিটাকি কাজ নিজেই করম্নন। সুযোগ থাকলে বাগান করম্নন, খেলাধুলা করম্নন। সাঁতার কাটুন।
৯·সপ্তাহে তিন/চার দিন কিছু সময় ফ্রি-হ্যান্ড (যন্ত্র ছাড়া) ব্যায়াম করম্নন। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী আপনার উপযুক্ত ব্যায়াম নির্বাচন করম্নন। কারণ সব ব্যায়াম সবার জন্য উপযুক্ত নয়। ব্যায়াম করছেন এ ধারণা মাথায় রেখে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করবেন না।
১০· কোমড়ে চওড়া বেল্ট ব্যবহার করতে পারেন। এতে মেদ দ্রম্নত বাড়তে পারবে না।
১১· প্রচলিত বিজ্ঞাপনের চমকে আকৃষ্ট হয়ে দ্রম্নত চিকন হওয়ার ওষুধ বা যন্ত্র ব্যবহার করতে যাবেন না। এতে আপনার অমঙ্গলের আশংকাই বেশী।
১২· প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শমত আপনার মুটিয়ে যাওয়ার মাত্রা নির্ণয় করে বয়সানুসারে সুষম খাদ্যের তালিকা তৈরী করম্নন।
১৩· ডায়াবেটিসে আক্রান্তô হয়ে থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমত চিকিৎসা গ্রহণ করম্নন। ওষুধ, ব্যায়াম, খাদ্যগ্রহণ তথা সার্বিক জীবনযাপন সংক্রান্তô তার সুনির্দিষ্ট এবং বিজ্ঞানসম্মত নির্দেশনা (যা শুধুমাত্র আপনার জন্য প্রযোজ্য) মেনে চলুন।
ম ডাঃ মুহাম্মদ কামরম্নজ্জামান খান
জনস্বাস্থ্য ও প্রিভেন্টিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগ
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।