ক্রনিক আমাশয় বা আইবিএস
অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক
এক তরম্নণের বয়স ২২, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আধুনিক এক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরে এক জটিল রোগে আক্রান্তô, যা তার পড়াশোনা ও জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। ছয় মাস ধরে তিনি আমাশয়ে ভুগছেন। দিনে চার-পাঁচবার টয়লেটে যেতে হয়। তলপেটে ব্যথা হয়, পায়খানার সাথে মিউকাস বা আম যায়। টয়লেট থেকে আসার পরও মনে হয় পুরোপুরি পরিষ্কার হয়নি এবং মাঝে মাঝে পায়খানার সাথে রক্ত যায়। এসব সমস্যার জন্য নিজে নিজে অনেক ওষুধ খেয়েছেন এবং অনেক ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছেন। অনেক রক্ত পরীড়্গা ও অন্যান্য পরীড়্গা করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে সে খুবই চিন্তôাগ্রস্তô হয়ে পড়েন। তিনি ভাবতে থাকেন, এ সমস্যার কি কোনো সমাধান নেই, নাকি এটা পায়ুপথের কোনো জটিল সমস্যা, না ক্যান্সার। ওপরের বর্ণনা থেকে আপনারা অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এটা কী ধরনের রোগ? এর কি কোনো চিকিৎসা এ দেশে নেই?
আজ আমরা যে রোগটি নিয়ে আলোচনা করতে যাবো তার নাম ওৎৎরঃধনষব ইড়বিষ ঝুহফৎড়স (ওইঝ) বা সহজ বাংলায় যাকে বলা যায় মানসিক অস্থিরতাজনিত আমাশয় রোগ। জেনারেল প্র্যাকটিশনার থেকে শুরম্ন করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের কাছে পরিপাকতন্ত্রের এই সমস্যা নিয়ে প্রচুর রোগী আসেন। পরিপাকতন্ত্রের এই বিশেষ রোগ নিয়ে গবেষণার কোনো অন্তô নেই। কিন্তু আজ পর্যন্তô এই রোগের কোনো স্বীকৃত কারণ পাওয়া যায়নি। এজন্য একে ঋঁহপঃরড়হধষ ফরংড়ৎফবৎও বলা হয়।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯-১২ শতাংশ এই রোগে আক্রান্তô। পুরম্নষ বা মহিলা যে কেউ এই রোগে আক্রান্তô হতে পারেন। অনুপাত ১০ঃ১১। এই রোগের কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা নেই। যেকোনো বয়সের যে কেউ এই রোগে আক্রান্তô হতে পারেন।
ওইঝ রোগের নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা না গেলেও বিজ্ঞানীরা বেশ ক’টি ব্যাপারকে এ রোগের জন্য দায়ী বলে মনে করেন। যেমন মানসিক কারণ, পরিপাকতন্ত্রের পরিবর্তিত চলাচল, পরিপাকতন্ত্রের প্রসারণ সংক্রান্তô জটিলতা ইত্যাদি। এসব কারণের মধ্যে ৫০ শতাংশ রোগীই মানসিক সমস্যায় ভোগেন। যেমন উত্তেজনা, দুশ্চিন্তôা, অবসাদগ্রস্তôতা, ভয় পাওয়া, মানসিক বিপর্যস্তôতা ইত্যাদি। পরিপাকতন্ত্রের পরিবর্তিত আচরণ আরেকটি উলে্নখযোগ্য কারণ।
এই রোগে যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তাদের আমরা দু’টি ভাগে ভাগ করতে পারি। একটি হলো পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, অন্যটি হলো অন্যান্য শারীরিক সমস্যা। পরিপাকতন্ত্রের সমস্যাগুলো হলো তলপেটে ব্যথা, যা টয়লেটে যাওয়ার পর কমে যায়, পেট ফুলে ওঠা। ওইঝ রোগীরা দুই ধরনের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারদের কাছে আসতে পারেন। এক ধরনের রোগীরা আসেন ডায়রিয়াজনিত সমস্যা এবং অন্য ধরনের রোগীরা আসেন কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত সমস্যা নিয়ে। আবার অনেক রোগী আসেন যাদের এই দুই ধরনের সমস্যাই থাকে। যেসব রোগী ডায়রিয়াজনিত সমস্যা নিয়ে আসেন তারা প্রায়ই ঘন ঘন টয়লেটে যাওয়া, পরিষ্কারভাবে পায়খানা না হওয়া, আম যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গের কথা বলেন। আর যারা কোষ্ঠকাঠিন্য, পায়খানার রাস্তôায় ব্যথা ও পেটে ব্যথা এসব সমস্যায় ভোগেন। ওইঝ-এর অনেক রোগী অনেক সময় মলদ্বারের বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগে থাকেন। ওইঝ-এর বেশিরভাগ মহিলা ও পুরম্নষ রোগী আবার এনালফিশার রোগে ভুগে থাকেন। অনেকে পাইলস রোগে আক্রান্তô হন। এনালফিশার বা পাইলস রোগে আক্রান্তô হলে পায়খানার রাস্তôা দিয়ে রক্ত যেতে পারে। পায়খানার রাস্তôা ফুলে উঠতে পারে, পায়খানার পর জ্বালা-যন্ত্রণা বা ব্যথা করতে পারে। অথবা পায়খানার রাস্তôা বের হয়ে আসতে পারে। উপসর্গের ড়্গেত্রে আরেকটি বিষয় অত্যন্তô উলে্নখযোগ্য যে, রোগীর বিশেষ ধরনের খাবার খাওয়ার পর রোগের উপসর্গ প্রকটভাবে দেখা দেয়। বেশ কিছু খাবার রয়েছে যেমন গরম্নর দুধ, গোশত, চিংড়ি মাছ, তৈলজাতীয় খাবার বা মসলাবহুল খাবার। এসব খাবার খেলে রোগীদের পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা দেখা দেয়।
ওইঝ রোগ নিরূপণের জন্য বিভিন্ন পরীড়্গা করা হয়। যেমন রক্ত পরীড়্গা, মলদ্বারে বিশেষ ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে পরীড়্গা (কলোনস্কোপি, সিগময়ডোস্কপি), বিশেষ এক্স-রে করা যেতে পারে। কলোনস্কোপি, সিগময়ডোস্কপি অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মাধ্যমে করানো উচিত। কারণ অনেক সময় মলদ্বার ও বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার রোগীরাও একই ধরনের উপসর্গ নিয়ে ডাক্তারদের কাছে আসতে পারেন। বিশেষ ধরনের পরীড়্গার মধ্যে রয়েছে থাইরওয়েড হরমোন পরীড়্গা, মল পরীড়্গা, দুধ সহ্যড়্গমতা পরীড়্গা ইত্যাদি।
ওইঝ রোগের চিকিৎসার অন্যতম প্রধান ধাপ হলো রোগীকে আশ্বস্তô করা। বেশিরভাগ রোগই মনে করেন তাদের ক্যান্সার হয়েছে। এ ব্যাপারে তারা অত্যন্তô উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ফলে তাদের রোগের উপসর্গ আরো প্রকট হয়ে ওঠে। প্রত্যেক রোগীকে অবশ্যই যথেষ্ট সময় দিতে হবে। ধৈর্য সহকারে তাদের সব সমস্যার কথা শুনতে হবে, প্রয়োজনীয় পরীড়্গা-নিরীড়্গা করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে, এটা দেহের কোনো অঙ্গের রোগ নয়, এটা অনেকটা মানসিক অস্থিরতা ও অন্ত্রের উল্টাপাল্টা আচরণের ফল। যেসব রোগী এসব উপদেশের পরও আশ্বস্তô না হন, কেবল তাদের ড়্গেত্রেই চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।
প্রত্যেক রোগীর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে ইতিহাস নিতে হবে। যেসব রোগী কোষ্ঠকাঠিন্য ধরনের ওইঝ রোগের বর্ণনা দেবেন, তাদের ড়্গেত্রে খাদ্যে যথেষ্ট পরিমাণ আঁশযুক্ত খাবার আছে কি না, নিয়মিত ব্যায়াম করেন কি না এবং টয়লেটে যথেষ্ট সময় দেন কি না এ ব্যাপারে ইতিহাস নিতে হবে। এসব রোগীর খাদ্যে আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খেতে বলতে হবে যেন কোষ্ঠকাঠিন্য কমে আসে। অন্য দিকে যেসব রোগীর ডায়রিয়াজনিত ওইঝ থাকে তাদের খাদ্যের তালিকা থেকে অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাবার, ফল ও চা ইত্যাদি কম করে খেতে বলতে হবে। এ ছাড়াও যেসব খাবার খেলে যেমন দুধ, পোলাও, চিংড়ি খেলে যাদের সমস্যা হয়, তা খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। অনেক রোগীর ড়্গেত্রে দেখা গেছে, দুধ বা দুধজাতীয় খাবার বাদ দিলে তারা বেশ ভালো থাকেন।
রোগীদের কিভাবে দুশ্চিন্তôা, অবসাদগ্রস্তôতা থেকে সহজে মুক্তি পাওযা যায়, সেসব শিড়্গা দিতে হবে। একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে একজন রোগীকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারেন। আচরণগত সংশোধন এবং শিথিলায়ন অনেক ড়্গেত্রে রোগীকে যথেষ্ট সাহায্য করে।
যেসব রোগীকে তার রোগ সম্পর্কে পুরোপুরি বুঝিয়ে বলা এবং আশ্বস্তô করার পরও উপসর্গ পুরোপুরি না যায়, কেবল তাদের ড়্গেত্রেই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। এসব ওষুধের বেশিরভাগই হলো তলপেটের ব্যথানাশক ওষুধ এবং অবসাদ, হতাশা দূর করার ওষুধ। ব্যথানাশক ওষুধ অন্ত্রের মাংসস্তôরের ওপর কাজ করে এর কর্মড়্গমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ব্যথা কম হয় ও ডায়রিয়া ভালো হয়। হতাশা দূরকারী ওষুধ ওইঝ রোগীদের ড়্গেত্রে অত্যন্তô কার্যকর। যেসব রোগীর খুব ঘন ঘন বাথরম্নমে যেতে হয় বা পায়খানা এলে ধরে রাখতে পারেন না কেবল তাদের ড়্গেত্রে ডায়রিয়া প্রতিরোধকারী ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য ধরনের ওইঝ রোগীদের ড়্গেত্রে আঁশজাতীয় খাবারের পাশাপাশি ইসুবগুলের ভুষি খাওয়ার জন্য উপদেশ দেয়া হয়।
অনেক রোগী যার ওইঝ-এর পাশাপাশি মলদ্বারে বিভিন্ন সমস্যা যেমন, এনালফিশার বা পাইলস বা মলদ্বার বের হয়ে আসা রোগে আক্রান্তô হন তাদের অবশ্যই বৃহদান্ত্র ও মলদ্বারের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। এ ড়্গেত্রে বাংলাদেশেই সব ধরনের উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে।
পরিশেষে এটা বলা যায়, এটি একটি মস্তিôষ্ক ও অন্ত্রের সংযোগজনিত রোগ। এর চিকিৎসা আছে এবং তা সোজা। দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস কিছুটা পরিবর্তন, দুশ্চিন্তôামুক্ত জীবনযাপন করেই যে কেউ এ রোগ থেকে নিস্তôার পেতে পারেন। এর পরও যদি সমস্যা থাকে তাহলে রোগীদের অবশ্যই এ রোগের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
লেখকঃ বৃহদান্ত্র ও পায়ুপথ সার্জারি বিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান, কলোরেকটাল সার্জারি, বঙ্গবন্ধ ু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। চেম্বারঃ জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল, ৫৫, সাতমসজিদ রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা। ফোনঃ ০১৭২৬-৭০৩১১৬